Wednesday 22 June 2022

সংখ্যা ৬।।২২জুন২০২২।।জিম্মেদারি ।। সোমা কুশারী

 জিম্মেদারি

সোমা কুশারী 

এ কিরণ কাহা ভৈল বা রে ?

গলির ওপার থেকে বুড়ি দাদির চিৎকার কানে যেতেই রাজুর হাত ছাড়িয়ে নেয় কিরণ, তারপর দুড়দাড় করে দৌড় লাগায়। সন্ধে বেশ অনেকক্ষণ গড়িয়ে গেছে গলির টালির চালের ঘরগুলোতে। টিমটিমে হলুদ রঙের বাল্ব জ্বলতে শুরু করেছে, টুনিচাচির ঘরে হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে। নিমকি আলিশা পিঙ্কি রাজুরা গোল হয়ে বসে কি যেন করছে, একটু পরেই ফজলুল করিম লোটন টিঙ্কাসরা আসর জমাবে। তিন পাত্তি খেলার এমন নিরাপদ জায়গা কোথায় মিলবে ? কিরণ এক ছুটে নিজের খোলির ভেতর সেঁধিয়ে যায়। দাদি ক'টা কানা বেগুন খাটিয়ায় বসে কুচোচ্ছে নীচে মেঝেতে বসে নিমকি কিরণের ছোটো বোন, এক গাদা পেঁয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছে । কিরণ লোটা থেকে জল নিয়ে ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে কালিধরা একটা প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে...

-এ দাদি এক বুন্দ তেল না বাটে !

-নাহি রে ! হম ওহি সেতো আজ খানা বনাইবে !

-কা ? ইয়ে ডিবিয়া কা তেল তু খানে মে ডালবু ? মত মরি গেইল বা তোহার !

রাগে গসগস করতে থাকে কিরণ, আর তাতেই নিমরতিয়ার মাথায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে, দুপয়সা রোজগার করছে বলে এত ঘমন্ড! এই তো সেদিন পর্যন্ত ঝাড়ুদারনীর কাজ করে বাপ মা মরা দুই নাতনিকে মানুষ করেছে। বড় মেয়েটা রাস্তার ওপারে ইস্কুল এর সামনে ঠেলা লাগাতে শুরু করার পর থেকেই যা একটু অবস্থা ফিরেছে সংসারের। সাত সকালে উঠে চানা উনা সেদ্ধ করে আলু কেটে রেডি করে ফুচকা ভাজে মেয়েটা। তারপর নাহা ধোকে হনুমানজীর ভোগ চড়ায়। ঘরে ভাতের জোগান থাকুক না থাকুক রোজ দুটো লাড্ডু হনুমান বাবার জন্য লেড়কিটা আনবেই। বহুত ভক্তি! এখুনি যে তেল নিয়ে জ্বলে উঠল তার কারণ ও ঐ পূজাপাঠ। রোজ একটা করে দীপ জ্বালায় সাঁঝবেলায়। সেই তেল আবার তুলে রাখবে অলগ সে। যত্ত সব নোটঙ্কি !

চুলার পাশে বসে রুটি সেঁকতে সেঁকতে কিরণ টিভি দেখছিল। দাদি, খাটিয়ায় আধশোয়া নিমকির মুখটা হাঁ হয়ে আছে। এই সিরিয়ালের চমকতি দুনিয়া মেয়েটাকে পাগল করে দেয়। যখন তখন লম্বা চোটি বেঁধে বাক্সে তুলে রাখা জরিদার সালোয়ার কুর্তা পড়ে গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। কিরণের এসব ভালো লাগে না। বহুত খারাপ খারাপ ছোকড়া আছে এই বস্তিতে কে কখন হিড়কি দেয় কী ঠিক আছে ? 

নিজের পড়াই লিখাই কিরণের হয়নি, বাপটা বহুত চুল্লু খেতো পেট দরদ নিয়ে হঠাৎ মরে গেল। মা মরল তার দু সাল বাদ। ঘরে তখন বড্ড অভাব। দাদির ভরসায় খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে দিন চলতো। চার ক্লাসের পর আর ইস্কুলমুখো হওয়া হলো না কিরণের! অবশ্য, ঐ ইস্কুল - ই এখন পেট ভরাচ্ছে। চানামাখা, পেয়ারামাখা, সিজনের আমড়া মেখে, ফুচকা বেচে, আলুকাটা বিক্রি করে দিন চলে একরকম। নিমকি নাইন ক্লাসে পড়ে, লিখাই পড়াইয়ে একবার মন নেই। সারাদিন টো টো করে ঘোরে। দাদির উমর হয়েছে, গোড় দরদ নিয়ে শুয়ে বসেই থাকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগায় নিমকি !

টিভি দেখতে দেখতে নিমকি হঠাৎ কি একটা শুনে ঝোপড়ির দরজা খুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কিরণ তাওয়াটা চুলার উপর থেকে নামিয়ে বোনের পিছে পিছে ছুটল, কদিন ধরেই নিমকির চালচলন ঠিক লাগছে না। কোথায় যায় কী করে কোনো পাতা নেই !

গলির ওপারে ঝুপসি মতো গাছটার নীচে নিমকি আর কেউ একজন কথা বলছে ! কিরণ লোকটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এ তল্লাটের কেউ কী ? নাকি অন্য কোনো লোক? বোনের নাম ধরে চেঁচাতে থাকে কিরণ,

-নিমকি! এ নিমকি !

মেয়েটা যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। লোকটা স্যাত করে সরে যায়। গাছ তলাটা পেরোতেই লাম্পপোস্টের এক ঝলক আলোয় লোকটাকে চিনতে পারে কিরণ। আরে এ তো হীরালাল! বস্তির বাসিন্দা ছিলো আগে। মাঝে কী একটা গন্দা কামের চক্করে পুলিশ পাকড়ে নিয়ে গেছিল। মাসকতক হলো ফিরেছে এ তল্লাটে। লোকটার তো অনেক উমর! কম সে কম চালিশ পচাশ সাল তো হবেই। ঘরে বিবি আর দোঠো লেড়কিও ছিলো। পুলিশ পাকড়ে নিয়ে যেতেই লেড়কিদের নিয়ে বিবি কোথায় যেন চলে গেছে।

নিমকি সে রাতে দাদির কাছে আচ্ছা মতো পিটাই খেলো। এত বজ্জাত কিছুতেই স্বীকার করলো না হিরালাল এর সাথে এত কিসের গল্প ? কিরণ মনে মনে ঠিক করল কাল রাজুকে বলবে কথাটা। রাজু দোসাদ কিরণের দিল কা রাজা ! ছেলেটা এই মেথরপট্টির সব থেকে ভদ্র ছেলে। কোনো গন্দা নেশা দারু উরু কী ভাং পাত্তা কিচ্ছু খায় না। মিউনিসিপালটির ক্যাজুয়াল লেবার আছে। ডেইলি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ময়লা তোলে, আর নিমকি বলে, মুখের বাঁশরীটি নাকি কিরণকে দেখলেই জোরে জোরে ফোঁকে ! নিজের মনে হেসে ওঠে কিরণ। ঠেলাটা আরেকটু সামলে নিতে পারলে রাজুর কথায় হ্যাঁ বলবে কিরণ। তার আগে নিমকিকে দশ কেলাশ পাশ করাবে। একটা ভালো কাজে ঢোকাবে। বুড়ি দাদির মোতিয়া বিন্দ কা অপারেশন করাবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কিরণ গেছিল সদর বাজারে, ডেইলি দশ কিলো আলু লাগে আলু কাটা মাখতে। সঙ্গে ধনিয়া পাত্তি, পুদিনা, খিরা, গাজর আর পেঁয়াজ ! ফিরতে ফিরতে রোজ-ই আটটা নটা বেজে যায়। বাড়ি ঢুকেই কিরণ চান ধান করে নেয়। দাদি তখন বসে বসে কাঠের জালে আলু উবালতে থাকে। কিরণ ভাত ডাল চোখা কী কোনো সব্জী রেঁধে ফেলে। আজ, ঘরে ঢুকতেই দাদি ফিসফিস করে বলে,

-ও ভাগ গই রে কিরণুয়া !

-কোন দাদি ?

-নিমকি !

-কা বোল রহি রে তু ? কাহা যাইবু !

দাদি আঙুল তুলে কোনের দিকে রাখা বড় ট্রাঙ্কটা দেখায়। কিরণের দু চোখে যেন মুহূর্তে অন্ধকার নেমে আসে। ওই ট্রাঙ্কেই তো সব কিছু থাকে ওদের... ডালা ভাঙা ট্রাঙ্কটার সামনের মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে কিরণ... পেট কাট কাটকে দশ হাজার রুপিয়া রেখেছিল কিরণ দাদির অপারেশন করবে বলে... নিজের আর নিমকির দু'জোড়া চাঁদির পায়েল, একঠো সোনার নথনি কিচ্ছু নেই কিচ্ছু না !

সারা দিন বুড়ি আর কিরণ ঘরে চুপচাপ পড়ে রইল। আস পড়শের লোকজন নানা কথা বলতে লাগলো। সবার এক কথা লেড়কিটাকে কেউ ফুসলেছে। রাজু এলো সন্ধেবেলায়। কিরণকে বললো,

-চল থানে মে !

-পোলিশ ? না বাবা না ! দাদি তীব্র আপত্তি জানালো।

কিরণ কিন্তু সোজা রাজুর সাইকেলে উঠে চললো থানায়। তাদের মতো গরীব আনপড় লোকজনকে থানার দারোগা ইচ্ছে করে ভয় দেখায়। এক্ষেত্রেও তাই হলো। রাজু আর কিরণের বহু কাকুতি মিনতির পরেও এফ আই আর হলো না। কিরণ বার বার হীরালালের নাম নিচ্ছে দেখে একটা সিভিক পুলিশ রাজুকে আড়ালে ডেকে বললো,

-তোর বৌ নাকি ? ওকে বল আনশান না বকতে ! সিয়ানা লড়কি পেয়ারের চক্করে ভেগেছে ! শুধুমুধু ঝঞ্ঝাট পাকিয়ে লাভ কী ?

দেখতে এক মাস কেটে গেল। নিমকি ফিরলো না। পেটের দায়ে ঠেলা নিয়ে বেরোলো কিরণ। দাদি, নিমকি ওরকম পালাতেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। আজকাল সারাদিন খাটিয়ায় শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তেজ বুখারও আসে। রাজু বলে, বুড়িকে হাসপাতালে দিতে। কিরণ রাজি হয় না। ঐ বুড়িকে ছেড়ে একা কী করে থাকবে ও ? বুড়ির জন্যে বড় ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আসে, জোর করে খাওয়ায়। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না।

সপ্তাহ খানেক আগে দোসাদ বস্তির দুটো মেয়ে হঠাৎ গায়েব হয়ে গেছে খবর পায় কিরণ। মেয়ে দুটো নিমকির সহেলি ছিল খবর দেয় পাশের বস্তির সরবতিয়া। আবার থানায় যায় কিরণ। বড় সাহেবের হাতে পায়ে ধরে, নিমকির খবর যদি পাওয়া যায়! না! কোনো খবর মেলে না! রাজু ভীষন রেগে যায়। বলে,

-বহিন বহিন করে তু পাগল হয়ে যাবি! নিজের কথা ভাব !

কিরণ কিছুতেই বোঝাতে পারে না মা বাপ হারা বোনটার কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে কিছুতেই ঘুম আসে না। কোথায় গেল মেয়েটা? কে কোন নরকে নিয়ে ফেললো ভাবতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। নিজে ছোটবেলা থেকে রাস্তায় নেমে রোজগার করেছে বলে এই ভয়ংকর দুনিয়ার ছবিটা ভালো করে চেনে ! রাজু বুঝতে চায় না। বার বার একই কথা বলে,

-চল সাদি করে নিই।

দাদির শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। নিজে উঠে বসতেও কষ্ট হয়। ঘরেই পিসাপ টাট্টি করে ফেলে। কিরণ ঘরে বাইরে খাটতে থাকে। রাজু ওকে বোঝায়,

দাদিকে হাসপাতালে ভর্তি কর। ও আর বাঁচবে না ! 

কিরণ রাজি হয় না। রাজু রেগে যায়। ঝগড়া বেঁধে যায় দুজনের।

-ও বুড়িহাকে নিয়ে কব তক ভুগবি ?

-জিন্দেগি ভর ! তো সে মতলব ?

-দেখ কিরণ ! ইসি মাহিনা সাদি হোবে তো বোল… নেহি তো...

-নেহি তো ? হম না করেম সাদি...

রাজু সত্যিই চলে যায়। একা হাতে দাদির সেবা যত্ন করতে করতে কোথা দিয়ে সময় চলে যায় টের পায়না কিরণ! যখন টের পায় তখন সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। এক প্রবল শীতের রাতে তেজ বুখার আর খাসিতে কষ্ট পেতে পেতে চলে যায় বুড়ি। বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে কিরণ। প্রতিবেশীদের সাহায্যে বুড়ির শেষ কাজটুকু সারা হয়। একদম একা হয়ে যায় কিরণ। পাশের ঝুপড়ির সুশীলা খবর দিয়ে যায়, গত হপ্তায় সাদি করেছে রাজু। বহু বড়ি সুন্দর ! কোনো জবাব দেয় না কিরণ। হনুমান বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জলের ফোঁটা গড়াতে থাকে শুধু।

দিন যায় মাস যায়। প্রতি হপ্তায় থানায় হত্তে দেয় মেয়েটা। নিমকির খবর চাই যে ! নিমকি ছাড়া আর কে আছে কিরণের ? দাদি মরেছে, নিমকিও যদি না ফেরে কী নিয়ে বাঁচবে কিরণ? ও যে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল, নিমকি লিখাই পড়াই করবে দশ কেলাশ পাশ দেবে নোকরি করবে !

কিরণের ঠেলা নিয়ম মতো রোজ স্টেশনের পাশে শ্রীলক্ষ্মীদেবী গার্লস স্কুলের বিরাট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। রঙিন ছাতার তলায় টিনের কৌটোয় নানান মশলার মিশেলে হাতা দিয়ে আলু মাখে কিরণ। ফুচকায় আলুমাখা ঠুসে ভরে দেয়, ধনে পাতা ছড়ায়... তেঁতুল জল ঢালে, স্কুলের মেয়েগুলো পাতা চেটে খায়। বকবক করে কিরণের সাথে, কিরণ ওদের যত্ন করে আলুকাটা চুরমুর মেখে দেয় তারপর সুযোগ পেলেই গম্ভীর গলায় বলে...

-পেয়ার বেয়ারকে চক্কর মে মাত পড় না সমঝি ! কভি ঘর সে ভাগ মাত জানা ! লিখাই পড়াই করো ! সির্ফ লিখাই পড়াই ! 

মেয়েগুলো খিলখিল করে হাসে। একটু দূরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে...

-ফুচকাওয়ালিটার মাথাটা গেছে ! এক্কেবারে গেছে !


সোমা কুশারী

পেশায় শিক্ষিকা, বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। লেখালিখি ভালোবেসে। চারপাশের সাধারণ ঘটনা আর অতি সাধারণ মানুষের জীবনের রোদ-বৃষ্টি নিয়ে সাহিত্যের হাটে পসরা সাজান। নিয়মিত বিভিন্ন অনলাইন ও মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর গল্প প্রকাশ পেয়ে থাকে।


1 comment:

  1. জিম্মেদারি গল্পটা ভালো লাগলো। সুন্দর লেখা।

    ReplyDelete

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...