Wednesday 15 June 2022

সংখ্যা ৫।। ১৫জুন২০২২।।ফেরা।।অভিষেক ঘোষ

 ফেরা 

অভিষেক ঘোষ 

বন্ধুদের সাথে একটা মেঘলা দিনে, বাস থেকে নেমে, একটা বিরাট বাগানে গিয়ে ঢুকেছিল রূপ । তার নাবালক দুই চোখে, মনে হয়েছিল ঈশ্বরের বাগান । ক্লাস ফোরের বাচ্চাদের স্কুল থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে গিয়েছিল । বাচ্চাদের চোখে ছিল খুশির ঝিলিক । তারপর একটা প্রাচীন আর বিরাট গাছের সামনে বাচ্চাদের গিয়ে দাঁড়াতে বললেন ম্যাডাম । কত শিকড়-বাকড়, প্রকাণ্ড কান্ড, ডাল-পালা, অজস্র পাতা আর তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে আরেক মহাপ্রাচীন নক্ষত্রের পাঠানো সোনার কুচির ঝিলমিল ! দুনিয়াটা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এমন দিনেই বদলে যায়। আর সেদিনই রূপের দুনিয়াটাও বদলে গেল । আমরা বলি না শক্তি অবিনশ্বর... তার ধ্বংস বা সমাপ্তি নেই, শুধু তার রূপের পরিবর্তন হয় ! জীবনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই । শরীরের মৃত্যু মানেই কি একটা গোটা জীবনের শেষ ? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীবন কি সঞ্চারিত হয় না ? যেখানে এর ব্যতিক্রম আছে, সেখানে অবশ্য বিষয়টা দুর্ভাগ্যজনক । তবে সেটা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম । শুনতে খুব অদ্ভুত লাগছে, তাই না ! আমাদের চারপাশে কিন্তু অদ্ভুত বিস্ময়ের অভাব নেই । মুখের চামড়া কুঁচকে যাওয়া, স্মৃতিহারা বৃদ্ধ মুখ, সদ্যোজাত শিশুর কচি আঙুলগুলির মায়ের আঙ্গুলের দিকে এগিয়ে যাওয়া; আবার অন্যদিকে ওই প্রাচীন গাছ, অনন্ত আকাশ, অনাদি সূর্য, মাটির সুদূর গভীরে সঞ্চিত পৃথিবীর প্রাণরস ভৌমজল, নরম ঘাসের উপর দিয়ে শিশিরস্নাত সকালের শান্ত প্রভাতী পদক্ষেপ, কিংবা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি - শিশুর চোখে এ সবই তো দারুণ বিস্ময়ের উপাদান ! সেদিন ঈশ্বরের বাগান থেকে বেরিয়ে, বাসে উঠতে উঠতেই রূপ অনুভব করল, প্রাচীন অস্তিত্বের বিস্ময় কেমন চমৎকার আনন্দের উৎস হতে পারে, কত নিবিড় হতে পারে তার অনুভূতি ! তারপর চলন্ত বাস থামল নির্জন একটা রাস্তার ধারে । ড্রাইভারের দেখাদেখি আরো অনেকে গেল টয়লেট সারতে । দিদিমণিকে লুকিয়ে রূপ নামল নীচে, বাসের পেছন দিকের অন্ধকারে গেল কৌতূহলে । তখন সন্ধ্যা নেমেছে, দিগন্তে ক্ষীণ লালের ছোঁয়ায় রাতের কালো ছোপ পড়তে শুরু করেছে । হঠাৎ রূপের পিছন থেকে একটা নেশাধরা গন্ধ রুমালের মতো, বেঁধে দিল তার নাক-মুখ । চোখদুটো ঘুমে বুজে এল । কতটা সময় কেটে গিয়েছিল, বুঝতে পারেনি রূপ । জ্ঞান ফিরলে রূপ বুঝল, অচেনা জায়গা । একটা অত্যন্ত পুরনো বাড়ি, কিন্তু এই ধরণের বাড়িতে আগে কখনও আসেনি সে । অনেকদিনের জমা ধুলোয় ভরা আসবাব । আর সম্পূর্ণ উধাও সেই নেশাধরা গন্ধটা, তার জায়গায় অন্য অন্য সব গন্ধ, কিছু চেনা আবার কিছু অচেনা । কিন্তু চোখের সামনে তখন সমস্ত অন্ধকার ! 

কিন্তু আশ্চর্য ! এখানে কোথাও কোন শব্দ নেই ! যেন কেউ রিমোটের 'মিউট' স্যুইচটা অন করে দিয়েছে, আর তারপর রিমোট-টা হারিয়ে গেছে । সেদিন থেকে দেখলে, রূপ তার জীবনটাকে অন্য এক পৃথিবীতে আবিষ্কার করল, এখানে শব্দ হয় না, রূপ-কে শব্দ তৈরি করতে হয় । মেঝেতে পা ঘষে, জলের জাগ-টা জোরে মেঝেতে রেখে, গান গেয়ে, চিৎকার করে, নিজের ছায়ার সঙ্গে বকবক করে, রূপ শব্দ তৈরি করে । এ এক অন্য অভিজ্ঞতা । ওইটুকু বয়সে একা একা, একটা বাড়িতে ভয় আর অজানার সঙ্গে লড়াই করে, নিঃসঙ্গ ধূসরতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে রূপ বুঝতে পারে, সে বদলে যাচ্ছে । এখানে মা নেই বাবা নেই, স্কুলের কোনো তাড়া নেই, বাগানে নিজের হাতে পোঁতা গাছগুলোয় জল দেওয়া নেই, দুপুরে প্রতি রবিবার উঠোনের গা-ঘেঁষা বারান্দায় ঠাকুমার সাথে শুয়ে, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনা নেই । এখানে রাত্রে মা পাশে শোয় না, বাবা স্বার্থপর দৈত্য, সুখী রাজপুত্র বা সেই ব্যাঙ্ রাজপুত্রের গল্প শোনায় না । স্কুলের পড়া করতে হয় না, অংক কষতে হয় না, টিভি নেই, মোবাইলে গান হয় না, ঘরের সেই লম্বা টিউবটা নেই, পড়ার টেবিল নেই, সেই চেনা দেওয়াল -ছাদ -জানলা -দরজাগুলো নেই । সর্বোপরি জীবনে কোনো নিয়ম নেই । সব সময় একটা গুমোট ভাব, সিলিং ফ্যান বা টেবিল ফ্যান কিছুই নেই, একটা স্যাঁৎস্যাতে গন্ধ চারিদিকে ! জানলা, দরজাগুলো সব সময় বন্ধ । বছরে একবার বোধহয় ঘরগুলো পরিষ্কার হয়, এত ময়লা ! পুরু ধুলো জমে আছে । চিৎকার করে ডেকে, কেঁদে, দরজা-জানালায় জোরে ধাক্কা দিয়ে কোন লাভ হয়নি । পুরনো মোটা কাঠের ভারী জিনিস সব । খাটে ছারপোকা, মেঝেতে আরশোলা আর ইঁদুর, রাত্রে অল্প মশা; আর তাদের জন্যই প্রথম প্রথম দুই একবার চমকে ওঠার মতো শব্দ শুনতে হয়েছে রূপ-কে । তারপর যত দিন গেল, ওই শব্দগুলো এখানকার নির্জনতার সঙ্গে এমন মিশে গেল যে, ওগুলোকে আর আলাদা করে এখন শোনা যায় না । দরজার পাশের খোপ দিয়ে ভিতরে একটা থালায় হয় রুটি, নয় ভাত আর একটা বড় বাটিতে জাবনা ঠেলে দেওয়া হয় তার জন্য । কে দেয়, তার গলা কেমন বোঝা যায় না । তার পায়ের শব্দ বা, অন্ততপক্ষে কখনও হাঁচি - কাসির আওয়াজটুকুও কখনও শোনা যায় না । খাবার দেওয়ার সময়টাও নির্দিষ্ট থাকে না । তবুও যে রূপ এই অন্ধকারে ডুবে যায়নি, তার কারণ প্রতি মাসে একবার করে দাদু আসে । অনেক দাড়িওয়ালা একজন বুড়ো লোক। কেক, জলের বোতল, বিস্কুট, মাখন, সন্দেশ এইসব এনে একটা আলমারিতে তিনি তুলে রেখে যান । রূপ গুনেছে দাদু আটাশ বা তিরিশ দিন বাদে বাদে আসেন... বুড়োটাকে রূপ ভালোই বাসে। তিনি মোটের উপর কথাও বলেন । মাথার উপরে ছাদে বসানো কাঁচটাই দিনের হদিশ দেয়... তা থেকেই রূপ হিসেব করে নিতে পারে ক’টা দিন গেল । 

এমনিতে রূপ যেখানে বেলা সাতটা-র আগে ঘুম থেকেই ওঠে না, সেখানে এই বাড়িতে ওই এক ফালি কাঁচের ফাঁক দিয়ে আসা আলো দেখবার জন্য, অনেক আগে থেকেই সে উঠে বসে থাকে । অবশ্য এখানে তো কোনো কাজ নেই তার, তাই রাত্রে খুব তাড়াতাড়ি শুয়েও পড়তে হয় । এখানে একটা বড় ঘর আর লাগোয়া বাথরুম আছে । ক্রমশ এই জীবনটাই রূপের ভালো লাগতে শুরু করেছে । এই বড়োসড়ো ঘরটায় অনেক খুঁজেছে রূপ... কিছুই নেই । রূপ এসেই দেখেছিল, যে সমস্ত দেওয়ালে দুপুরের আলো ভালোভাবে এসে পড়ে, সেই সব দেওয়ালেই ছবি আঁকা । কাঠ কয়লা, এমনকি জলে ভেজা ময়লা ধুলোও আঙুল দিয়ে টেনে টেনে, দেয়ালে ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে, এমনটাই বুঝেছিল ছোট্ট রূপ । এখন রূপও সেই অভ্যেসে অভ্যস্ত । ভোর থেকে অনেকক্ষণ স্কাইলাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ক্লান্ত হয়ে, সে ম্লান আলোয় বদলে যাওয়া আসবাব ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ছায়াগুলো লক্ষ্য করতে থাকে । তারপর খিদে ভুলতে ছবি আঁকতে থাকে । দিনে দু'বার দরজার পাশের খোপে তার জন্য খাবার আসে । আর ঘরের একমাত্র আলমারিতে রাখা দাদুর আনা খাবারগুলো আগে দ্রুত শেষ হয়ে যেত, এখন রূপ সেগুলো সঞ্চয় করে রাখতে শিখেছে । নিত্য  অভাব মানুষকে অসংযমী করে তোলে, কিন্তু অনিয়মিত অভাব মানুষকে সঞ্চয়ী করে । রূপ কিন্তু খুব নিস্তেজ বোধ করে আজকাল । তার বারবার মায়ের মুখটা মনে পড়ে । চোখ বুজে মায়ের গলাটা মনে করার চেষ্টা করে সে । এখানে তার দুবার জ্বর এসেছিল প্রথম দিকে, কেউ জানতেও পারেনি । আবার নিজে নিজেই কখন সেরে গেছে । রূপ এখন অন্ধকারেও খুব ভালো দেখতে পারে । ঘরের একমাত্র চওড়া কাঠের কারুকাজ করা টেবিলটার নীচে ঢুকে রূপ একটা সমুদ্রের ছবি আঁকে । কত চেষ্টা করেও সে ছবিতে দেখা সমুদ্রের মতো জ্যান্ত ঢেউ কোনোদিন আঁকতে পারেনি । সব রঙ্-ই বা এই বদ্ধ ঘরে কোথায় পাবে সে ? বাবা রূপকে অল্প অল্প আঁকা শিখিয়েছিল । কিন্তু এতো কঠিন আঁকা ? রূপ কখনো সমুদ্রে বেড়াতে যায়নি । ওর খুব ইচ্ছে করে, ঢেউগুলো দেখে এসে ছবি আঁকতে । কিন্তু এখানে সমুদ্র কোথায় ? সে কীভাবে যাবে ? সে যে বন্দী ! জীবন যদি নদী হয়, তাও সমুদ্র বহুদূর ! আর জীবন জেলখানা হলে, সমুদ্র অচিনপুর । 

একটা কথা আছে না, একেকটা দিন অন্য রকম ! এই গল্প যেদিনকার, সেদিনটাও ছিল তেমনি অন্যরকম । রাতে যাদের উৎপাতের শেষ নেই, সেই দুই ক্ষুদ্র প্রাণিকে সকাল থেকে তাড়া করে করে, কোণঠাসা করে অবশেষে নিকেশ করল রূপ । তার সঞ্চিত খাবারের আলমারিটা ও কিছুটা সুরক্ষিত হলো এইভাবে । ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীরে সে যখন বড় টেবিলটার ঠিক উপরের স্কাইলাইট-টার দিকে তাকালো, অবাক হয়ে দেখলো কাচটার উপর জমে থাকা ময়লাগুলো, বড়ো বড়ো জলের ফোঁটায় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে । বৃষ্টি হচ্ছে তাহলে ! এখানে আটকে যাওয়ার পর থেকে রূপ এই প্রথমবার বৃষ্টি দেখলো । প্রথমে ময়লাগুলোর জন্য কাচটা কাদা-কাদা হয়ে গেল । তারপর ফোঁটায় ফোঁটায় ময়লা ধুয়ে যেতে লাগলো । এবারে কাচের সঙ্গে কাঠের ফাঁকটা দিয়ে গড়িয়ে নামতে লাগল ময়লা জল । পরে দেখা গেল টেবিলটা জলে জল হয়ে গেছে । কোণ বেয়ে সেই জল মেঝেতে গড়ালো । বিকেল নাগাদ বৃষ্টি থামল । আর ঠিক তখনই ঘরের বাইরে যাওয়ার দরজাটায়, তালা খোলার শব্দ হলো । তারপর পাল্লাটা অল্প ফাঁক হলো আর পাল্লাদুটোর ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো আর পুরনো একজোড়া কেডস দেখা গেল । দাদু ঢুকেই কী বলবেন, রূপ জানে । ঠিক তাই হলো । দাদু কাঁপা গলায় বললেন, "হয় তুমি বেঁচে থাকবার চেষ্টা করবে, নয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে । খুশি হলাম এটা দেখে যে, তুমি প্রথম চেষ্টাটাই করছো।" রূপ জানে দাদুও একদিন তার মতন এই ঘরেই বন্দী ছিলেন । দাদু রূপ-কে গল্প করেছেন, প্রথম প্রথম তিনি এই দেওয়ালগুলোকে, দরজা-জানালাগুলোকে ঘেন্না করতেন । তারপরে এগুলোতেই তাঁর অভ্যাস হয়ে গেল । আরও পরে দাদু এই ঘরের দেয়াল, মেঝে, ছাদের ওই আলো আসার অবকাশটুকু, - সবকিছুর উপরেই নির্ভর করতে শুরু করেন । ঠিক এই অবস্থায় রূপ নিজে এখন রয়েছে । তাইতো সে এত এত ছবি আঁকে । আঁকা ছবির উপর আবার অন্য ছবি আঁকে । এমনকি রূপ ওর মাকে একটা দেওয়াল-চিঠিও লিখেছে । একটা পুরনো বাঁধানো ছবির আড়ালে সেটা লুকানো রয়েছে দেওয়ালের গায়ে । দাদু বলেছিলেন তারপর তিনি একদিন মুক্তি পান । কিন্তু বাইরে গিয়ে তাঁর চোখে আলো সহ্য হচ্ছিল না । মনে হচ্ছিল গাড়িগুলো ভীষণ জোরে ছুটছে । লোকজন বড্ড জোরে আর তাড়াতাড়ি কথা বলছে । বাইরে বড্ড আওয়াজ চারিদিকে । কেমন ভয় ধরে যায় দাদুর মনে । তাঁর মনে হয়েছিল পৃথিবীটা যেন বড্ড জোরে ঘুরছে । সেই থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন । রূপ-কে তিনি কেন আটকে রেখেছেন, তিনি বলেননি । তিনি তো চাইলেই মুক্তি দিতে পারেন তাকে ! কিছুই বলতে চান না তিনি । চুপ করে থাকেন, গম্ভীর হয়ে যান । তারপর কখনো ধমকে ওঠেন, - "থামো তো বাপু, এতো প্রশ্ন কোরো না, এত শব্দ কোরো না ।" সত্যি অতগুলো দিন মানুষের কথা না শোনার পর, এত কথা শুনে যাওয়া, সহ্য করা শক্ত কাজ । হার মানতেই হয় রূপ-কে। দাদুই রূপ-কে এই ঘরেতে বন্দী করেছেন, এতদিনে সে এটা জেনে গেছে । তিনি এটা কেন করেছিলেন, সেটা বোধহয় প্রয়োজনীয় নয় । কিন্তু তিনি যে এটা করেছিলেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । 

কিন্তু এবার গোড়া থেকেই দাদুকে দুর্বল মনে হল । মরা ইঁদুরদুটোকে লেজ ধরে বাইরে ফেলে দিয়ে এলেন তিনি । রূপ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো, "মরে গেলে তারপর আমাদের কী হয় ?" দাদু একটু ভেবে জবাব দিলেন, "আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানেই আবার ফিরে যাই ।" রূপ জানতে চায়, কিন্তু প্রশ্ন খুঁজে পায় না । তাই আপন মনেই বলে, "কিন্তু আমার তো মনে নেই, আমি কোথা থেকে এসেছিলাম ?" এবার দাদু ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন, "ওইখানেই তো মুশকিল । আমরা মনে করতে পারি না বলেই, ফিরতেও পারি না । অথবা হয়তো ফিরতে চাই না!" এরপর তিনি পা থেকে কেডস্ খুলে ফেলেন । রূপ দেখে, দাদুর জুতোর তলা ফেটে গিয়েছে । পায়ের তলায় ফোসকা পড়ে লাল হয়ে আছে । একটা পা থেকে তো অল্প রক্তও বেরিয়েছে, দেখে মনে হয় রূপের । তারপর দাদু জাগ থেকে জল খেতে খেতে বলেন, "আমি আর লড়তে পারছি না... হার মেনে নিয়েছি । এবার শুধু মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা । তবে তার আগে তোমায় একটা উপহার দেবো ।" একথা শুনে রূপ-এর চোখে জল আসে । দাদুর কপালে হাত দিয়ে দেখে, খুব জ্বর এসেছে ওঁর । রূপ তাঁর কপালে হাত দিলেই একটা বহু পুরনো ক্ষত অনুভব করে, কপালে হাত না রাখলে যার অ্তিত্ব বোঝা যায় না । দাদু টর্চ জ্বেলে চারিদিকে তাকিয়ে মন্তব্য করেন, "ইস্ ! বড্ড ঝুল আর ময়লা জমেছে দেখছি । একটু পরিষ্কার করতে পারো না ঘরটা ? নিজের থাকার জায়গা নিজেকেই পরিষ্কার রাখতে হয় ।" রূপ অবশ্য মাঝে মাঝে ঘরটা পরিষ্কার করে - নাহলে তো থাকাই যেত না । বাড়িতে তাকে দিয়ে একটা কাজও কেউ করাতে পারতো না । আর এখন দেখো দেখি - এ এক নতুন রূপ । 


একটু পরে খোপ দিয়ে দুটো থালা আসে ভিতরে । দাদু তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েন । রূপ বাড়িতে মা-কে দেখে জলপট্টি দিতে শিখেছিল । আগেও সেটা কাজে লেগেছে । এদিনও সে নিজেই দাদুর কপালে বার সাতেক জলপট্টি লাগালো । ওই কপালে হাত দিয়ে তার নিজের ঠাকুমাকে মনে পড়ছিল, চোখে জল এসে যায় রূপের । এরপর সে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে ! ভোরের ঠিক আগে দাদু ঘুমন্ত রূপকে ডেকে তুললেন । ধড়মড় করে উঠেই রূপ স্কাইলাইটের দিকে তাকালো । নাহ্ এখনও দিনের আলো সেভাবে ফোটেনি । দাদু দরজাটা পুরো খুলে দিলেন, এতটুকু শব্দ না করে । বোঝা গেল, ওরা কেউ তালা দেয় নি । রূপ-কে নিয়ে দাদু বাইরে বেরিয়ে এলেন । বাইরে পা দিয়েই বিহ্বল রূপ সভয়ে পিছিয়ে গেল । কিন্তু কীসের ভয় ? এ তো আমাদের আজন্ম-পরিচিত পৃথিবী । কিন্তু এখন ওই ঘরটার চেয়েও কি তা বেশি চেনা, রূপের কাছে ? ওই ঘরটার আশ্রয়টুকুই যে এখন রূপের পৃথিবী । 

তারপর লম্বা একটা করিডোর পেরিয়ে, নোংরা ঝোপ-ঝাড় ভ'রা উঠোন পেরিয়ে, ওরা দু-জন বাইরের চৌহদ্দিতে এসে দাঁড়ায় । ঝোড়ো হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোমেলো করে দেয় রূপের চুলগুলো । আর ঠিক তখনই সেই দামাল হাওয়ায় একটা অচেনা গাছের ডাল, সজোরে এসে চপাট করে আঘাত করে তার ছোট্ট কপালে । আচমকা আঘাতে সে ককিয়ে ওঠে, দাদু কিন্তু নির্বিকার । সে টেরও পায় না, দাদুর কপালের মতোই ওই একই জায়গায় তার কপালেও চিরতরে একটা ক্ষতচিহ্ন আঁকা হয়ে গেল । রক্ত ঝরে জায়গাটা থেকে । সে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে, এখনও রাতের অন্ধকার কিছুটা গায়ে মেখে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা, আর সামনে ভবিষ্যৎ । ঝিঁঝির ডাক যেন কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়... এমনটাই মনে হয় রূপের । দাদু ওর হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন, "আজ তোমায় সমুদ্র দেখাবো । তোমার উপহার । তারপর তুমিই ঠিক করবে, তুমি কোথায় ঢেউয়ের ছবি আঁকবে - অন্ধকার ওই ঘরে নাকি বাইরের পৃথিবীর এই আলোতে ? একদিন আমারও এই সুযোগ এসেছিল... আমি বেছে নিতে পারিনি । আজ তোমার পরীক্ষা । 

ধীরে ধীরে সৈকতে আলোর ছোঁয়া লাগে... দূরে কয়েকটা ডিঙি নৌকায় ঢেউয়ের ধাক্কা ও তাদের টলোমলোভাব চোখে পড়ে রূপের । অসুস্থ শরীরটা টেনে টেনে এগিয়ে চলেন দাদু । সামনে কিছু দূরে যেটা দেখা যাচ্ছে আর অমন গর্জন শোনা যাচ্ছে, ওটাই কি তবে সমুদ্র ? ওইগুলোই তবে ঢেউ ? ফসফরাসের সাদা আলো ম্লান করে, ঢেউয়ের মাথায় ছড়িয়ে যাচ্ছে কমলা-লাল রঙের স্রোত । ঝাউয়ের বন হাওয়ায় শনশন্ শব্দ তুলছে আর দুলছে… বুঝদারের মতো মাথা নাড়ছে বাতাসে । বালি উড়ছে মৃদু । দাদু নামতে নামতে হঠাৎ ধপ্ করে বালির উপর বসে পড়েন । রূপ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, চিৎকার করে ডাকে । সাড়া না দিয়ে, তিনি ওখানেই শুয়ে পড়েন চরম ক্লান্তিতে । কেডস্ না পরেই চলে এসেছেন, গোড়ালি অব্দি তাঁর বালি চিকচিক্ করছে । দাদু অস্ফূটে কেবল বলেন, “যাও… ।” রূপেরও খালি পা, খালি গা । কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর, রূপের শরীর থেকে যেন অগোচরেই একটা শিকল খসে পড়ে । বালির উপর কচি কচি পায়ের ছাপ ফেলে রূপ ছুটে চলে যায় জলের নাগালে, সাদা ফেনায় সে পা ডোবায় । ঢেউগুলো তখন তার দিকে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছে ।

অভিষেক ঘোষ 

পেশায় শিক্ষক, নেশায় কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক । প্রকাশিত কবিতা সংকলন 'শব্দের অভিযান' ও উপন্যাস 'পরজীবী' ।






No comments:

Post a Comment

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...