Wednesday 21 September 2022

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর


নরকের প্রেমকাহিনী 

 তন্ময় ধর 

'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভিজাত্য নিয়ে মেয়ে প্রজ্ঞার দিকে তাকালেন মহারাজ ধরাধরেন্দ্র।

মা পাশ থেকে করুণ মুখে বললেন 'হ্যাঁ রে মা প্রজ্ঞা। আমার কথাটা শোন। তোর বাবা এমন রাশভারী নাম আর আভিজাত্য নিয়েও আমার জীবনটা নরক করে দিয়েছেন। আর এর নামই নরক। তোর জীবন নরক করে দেওয়ার জন্য যেন এক পা বাড়িয়েই আছে...'

'তুমি বুঝছো না মা। ও কুড়ি বছর বয়সেই এক রাতে কামাখ্যা মন্দির বানিয়ে ফেলেছে। গোটা ভারতবর্ষের ওই পুরুষতান্ত্রিক বৈদিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে মাতৃতান্ত্রিক তন্ত্রের লড়াইয়ে একমাত্র মুখ ও। শুধু এই প্রাগজ্যোতিষ নয়, সমগ্র পূর্বভূমিকেই ও একার হাতে রক্ষা করবে...'

'দ্যাখ মা, জনগণ এসব মন্দির, প্রকৃতি-পুরুষ, বেদ-তন্ত্রের দর্শন বোঝে না। তাদের কাজ চাই, পেটে ভাত চাই...'

'মা, ও কর্মেই বিশ্বাসী। বৈদিকদের শুষ্ক জ্ঞানকান্ডের কচকচানি থামাতে বিশাল এক কর্মকান্ডের পরিকল্পনা করেছে। গ্রামে-গ্রামে ক্ষুদ্র ও স্বনির্ভর কর্মযোজনা, সমবায় প্রকল্প, যৌথ খামার ইত্যাদি নিয়ে ব‍্যাপক ক্ষেত্রসমীক্ষা করে গবেষণা করছে ও...'

'বলিস কি রে, মা !'

'তবে আর বলছি কি ! মা, এই বয়সেই ও যা ত্রিকালদর্শী দৃষ্টি দেখাচ্ছে তাতে ওর কাজকর্ম সুদূর ভবিষ্যতে বৈপ্লবিক বলে পরিগণিত হবে। ভবিষ্যতের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাংখ‍্যদর্শন, সাম‍্যবাদ- সব কিছুর ভিত্তিভূমি তৈরি করছে ও...'

'সবই বুঝলুম। কিন্তু নামটা ? একে নরক, তায় অসুর! ও নাম নিয়ে বিড়ম্বনার একশেষ হবে। রাস্তাঘাটে বেরুলে যখন লোকে আমাকে বলবে 'ওই যে নরকাসুরের শ্বশুর যাচ্ছেন' তখন আমার সেটা শুনতে কতখানি খারাপ লাগবে তুমি বুঝছো না। আর শুনেছি সে ছেলের বংশপরিচয় নেই, নিজেকে ভৌম অর্থাৎ পৃথিবীর সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয়। তার সাথে তোমার বিয়ে দিলে আমাদের আভিজাত্যটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, একবার ভেবে দেখেছো ? তখন কি সম্মান বাঁচাতে ঐসব আর্থসামাজিক সাম্যবাদ আর গণতন্ত্রের গবেষণা ধুয়ে জল খাবে ?' আবার কমল মিত্রসুলভ স্বরে গর্জে উঠলেন ধরাধরেন্দ্র। 

'বাবা, তাহলে কি তুমি বলতে চাইছো যে, নাম আর আভিজাত্যই তোমার কাছে শেষ কথা ?'

'বলতে চাইছি নয়, সেটাই বলছি' এক চূড়ান্ত কঠোর গার্জেনের গর্জন শোনা গেল ধরাধরেন্দ্রর গলায়।

'মা, তোমারও কি একই বক্তব্য ?'

'না রে মা। তোর বাবা চিরকালই আমার বক্তব্যকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনাটাই নিজের কর্তব্য মনে করেছে। কিন্তু তাতে কি আর ভবিতব্য পালটায় ? তুই নরককে বল, তার সুকর্মে আমার সমর্থন আছে। সে এসে যুদ্ধ করে তোর বাবাকে পরাজিত করে তোকে হরণ করে নিয়ে যাক...'

'কি বলছো মা !! তাহলে আমার শাড়ি, গয়না, মেক-আপ, কনেযাত্রীদের সাজগোজ, নিমন্ত্রিতদের প্রীতিভোজ- এসবের কি হবে ? বিয়ে মানে কি শুধুই দু'টি প্রাণের মিলন ? বিয়ে মানে দু'টি প্রাণ এক হয়ে এক অনন্ত জীবনবিস্তারে কালপারাবার পার হয়ে চলা, লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তরে এক নিরন্তর প্রাপ্তির পূর্ণতা। জিয়াভরলির তীরে যখন নরকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, তখনই সে এই চিরমিলনের কথা বলেছিল। আমাদের অসীম অনন্ত অস্তিত্বের কথা বলেছিল। এই প্রাণমন্ডলের প্রতিটি স্পন্দনে, এই জ্যোতির্মন্ডলের প্রতিটি উদ্ভাসে, এই অন্তরীক্ষ-নক্ষত্র-নীহারিকার অপার ঐশ্বর্য্যবিস্তারে- সর্বত্র আমরা আছি…’

‘হুম। তার মানে নরক প্রথম দর্শনেই অনেক কাব্যি করে আমাদের কন্যার সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমটাই আগে খেয়েছে’ বজ্রগম্ভীর স্বরে ধরাধরেন্দ্র বললেন ‘প্রজ্ঞার মা, আমি না হয় রাজকার্যে ব্যস্ত থাকি। তুমি তো দেখতে পারো, তোমার মেয়ে ওইসব কল্পনাবিলাসী সুররিয়াল বায়রনিক হিরোদের সাথে মিশে অন্য নক্ষত্র-নীহারিকায় উড়ে বেড়াচ্ছে কিনা…’

‘বাবা, কথাটা সরাসরি আমাকে বলতে পারো। আমার পছন্দ-অপছন্দ, আমার চিন্তার স্বাধীনতা- এসব তোমার রাজকার্যের এক্তিয়ারে পড়ে না। আমি এই মুহূর্তে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত...'

'এমন করিস নে, মা। আমার কথাটা একটিবার শোন। মাথা গরম করে, বিবাদ করে কোন কাজ হয় না। তুই নরককে একবারের জন্য আলোচনার টেবিলে ডাক...'

'কার ভরসায় ডাকব, মা ? বাবার কথাবার্তার ধরন তো দেখছো !'

'আমি কথা বলব। কোর্টে এফিডেভিট করে যদি নামটা বদলানো যায়। আর হাইটটাও শুনেছি মাত্র পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। আজকাল নানারকম ওষুধ-টষুধ পাওয়া যায়। যদি তা খাইয়ে একটু বাড়ানোর চেষ্টা করা যায়...'

'মা, অ্যাম আই আ জোক টু ইয়্যু ?' চোখে জল এল প্রজ্ঞার 'যেভাবে তোমরা কথা বলেছো, তাতে এ প্রাসাদে আমার থাকার অর্থ হয় না। আপাতত আমি মামাবাড়ি চললাম। ওখান থেকেই নরকের কাছে যাব। তোমাদের সাথে হয়ত আর দেখা হবে না' বাবা-মাকে প্রণাম করে প্রজ্ঞা প্রাসাদ ত্যাগ করতে উদ‍্যত হল।

'অবুঝ হোস নে, মা। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিস না। আমরা তো আলোচনায় রাজি আছি...' প্রজ্ঞার মায়ের কথা থামিয়ে আবার গর্জন করলেন মহারাজ 'কেন আটকাচ্ছো মহারাণী ? রাজনন্দিনীকে একবার বাপের ছত্রছায়ার বাইরে বেরিয়ে কঠিন দুনিয়াটা দেখতে দাও না ! আর ওই কল্পনাবিলাসী, তান্ত্রিক সুরাপায়ী, প্রেতসঙ্গমকারী ওই নরকাসুর না কি যেন, ওটাকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসতে দাও। তারপর আমি বুঝিয়ে দেব কত ধানে কত চাল, আর কত চালে কত পাটিসাপটা'

'বাবা, আমি শুধু নামেই ধরাধরেন্দ্রনন্দিনী নই, আমি যুদ্ধকালে রণচণ্ডী। যুদ্ধ কিভাবে জিততে হবে, তা আমার জানা আছে। চললাম...'

আবার বাধা পড়ল। ঘরে যেন এক প্রবল বজ্র চমক। তড়িৎশিখার মত চমকে দিয়ে হাজির এক আগন্তুক। আর উপস্থিত হয়েই তার ঘোষণা ‘আমিই নরক। এভাবে বিনা নিমন্ত্রণে অজ্ঞাতসারে আপনাদের আলোচনার মাঝে উপস্থিত হওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কিন্তু আপনারা বোধহয় আমাকে মারতে চাইছিলেন। তার জন্য যুদ্ধের আয়োজন বা রাজকীয় আলোচনাসভার আয়োজন করে বিলম্বের কি প্রয়োজন? আমি একাই যুদ্ধে কয়েকশো সৈন্যের মোকাবিলা করতে সক্ষম। আলোচনাতেও কয়েকশো পন্ডিতকে একসাথে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম। হয় সৈন্য ডাকুন, পন্ডিতদের ডাকুন, বা নিজেরাই পরখ করুন। কিন্তু আমি চাই এখনই, এই মুহুর্তেই ব্যাপারটির নিষ্পত্তি হোক। হ্যাঁ, আমি মহারাজ ধরাধরেন্দ্রকে ধরাশায়ী করে তাঁর কন্যাকে হরণ করার জন্যই এখানে এসেছি। সফল না হয়ে আমি যাব না…’

‘কনফিডেন্স ভাল, কিন্তু ওভার-কনফিডেন্স ভাল নয়, নরকাসুর’ ধরাধরেন্দ্র চমক সামলে গর্জে উঠলেন ‘দূর ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে সিনেমা-সিরিয়ালে নির্বোধ লেখক-পরিচালকেরা এমন অবাস্তব সংলাপ এবং দৃশ্যায়নের কল্পনা করবেন। কিন্তু বাস্তবে এসব হয় না। ধরো তলোয়ার। দেখি কেমন তোমার বীরত্ব ?’

অসিযুদ্ধে বেশীক্ষণ নরকের সামনে দাঁড়াতে পারলেন না ধরাধরেন্দ্র। 

'সৈন‍্য আর পন্ডিতদের ডাকুন এবার। সমস্ত বিদ্যার পরীক্ষা হয়ে যাক' নরক এবার গর্জন করলেন।

'ওহে ঐন্দ্রজালিক, তুমি এখানে কিন্তু প্রেমকাহিনী রচনা করতে এসেছো, বিদ‍্যে জাহির করতে নয় ' একটু যেন ডিফেন্সিভ মোডে চলে গেলেন ধরাধরেন্দ্র 'প্রত‍্যেকটা স্টেপ বুঝে বুঝে ফেলো, বাছাধন। নইলে অর্ধেক রাজত্ব সহ রাজকন্যা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে'

'বাবাজীবন, যুদ্ধবিগ্রহ না করে, তন্ত্রমন্ত্রের শো-অফ না দেখিয়ে বাস্তবের সঙ্গে একটু আপোষ করো' মহারাণী মুখ খুললেন এবার 'আমার একমাত্র মেয়ে চরম রোমান্টিক প্রেমকাহিনী চায়...'

'বেশ। আমি আগে বিস্তারিত টার্মস অফ রেফারেন্স জমা দিই। আপনারা দেখুন, প্রশ্ন করুন, উত্তর শুনুন...'

'আমিও আমার টার্মস অফ রেফারেন্সে দু'তিনবার অনার কিলিং-এর অ্যাটেম্পট রাখব...' ধরাধরেন্দ্র ইন্টারফেয়ার করলেন।

'ওফফ, এই লোকটাকে নিয়ে পারা যাবে না' মহারাণী বিরক্ত।

'বাবা, মা, আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই' প্রজ্ঞা গম্ভীর হলেন 'যদি চাও, তোমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারো। কথাগুলো অত্যন্ত গভীর। তোমরা হয়ত আমাদের এই উনিশ-কুড়ি বছরের প্রেমকাহিনীকে চরম তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছো, কিন্তু আমাদের এ কাহিনীতে অনেক যুগের স্পর্শ রয়েছে, এই প্রাগজ্যোতিষ -পুনর্ভবা- সরস্বতী- দৃষদ্বতী বিধৌত বিস্তীর্ণ ভূমির বহুস্তরীয় ইতিহাসের স্পর্শ রয়েছে। অল্পকালের মধ্যেই আমাদের দৃষ্টিগম্য আগামীতে আর্যাবর্তে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকেও নাড়া দেবে আমাদের প্রেমকথা...'

'স্বপ্ন না দেখে দুনিয়াটাকে বাস্তবের মাটিতে পা রেখে দেখতে শেখো...' বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে গেল প্রজ্ঞার স্বপ্নটা। হস্টেলের ঘরের দরজায় নক। দরজা খুলতেই সেই সুপুরুষ সিনিয়র দাদা। গতকালের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বারবার চোখে চোখ পড়েছিল প্রজ্ঞার। নাম সুরজিৎ। অনুষ্ঠানের শেষে লম্বা-চওড়া কথায়, শো-অফে, সেন্স অফ হিউমারে অনেকটাই পটিয়ে ফেলেছে প্রজ্ঞাকে। আজ বোধহয় বাকিটুকু করতে এসেছে।

'কি ব্যাপার, প্রজ্ঞাদেবী? এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছেন? নরকাসুরের স্বপ্ন-টপ্ন দেখলেন নাকি ?'

'স্ট্রেঞ্জ! আপনি কিভাবে গেস করলেন ?'

'গত তিন বছরে দেখছি তো। গৌহাটির এই নরকাসুর হিলটপে মেডিক্যাল কলেজে পড়তে এসে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের পরদিন কোন না কোন সুন্দরী ওই স্বপ্ন দেখেই। আগে নরকাসুরের প্রেমকথা নিয়ে নাটক হত। আমিই হিরোর রোলটা করতাম' নায়কোচিত ভঙ্গীতে নিজের চুলে আঙুল চালাল সুরজিৎ 'এনিওয়ে, স্বপ্নে প্রেমকাহিনী কদ্দুর এগোলো' ?

'এগোয়নি মশাই, পিছিয়েছে। আমার বাবার ওই 'নরক' নামে আপত্তি আছে। পরবর্তী স্বপ্নে উনি ঘটক ধরে ভাল ভাল নামের পাত্র খুঁজে এই প্রেমকাহিনী ভেঙে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন...'

'অ্যাই মরিয়েসে ! তা তুমি...মানে আপনিও বেশ কড়া করে স্বপ্ন দেখুন। আর সেসব স্বপ্নে ওইসব ঘটককে ভাগিয়ে সরাসরি আসল নরককে ঢোকান...'

'আসল নরক পামু কই'?

'আমিই রোলটা করে দিতে পারি। আমার উজানি আসামে তিনটে চাবাগান আছে, দার্জিলিয়ের কাছে আরো দু'টো। এই নর্থ-ইস্টের চারটে স্টেটে মোট ছ'খানা হোটেল আছে। জালুকবাড়িতে সুবিশাল রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি। শিলং, তাওয়াং, ডিব্রুগড়ে আরো তিনটে বিশাল বাগানবাড়ি। আর আমাদের বংশেও একটা মিথ আছে, আমরা দিহিঙ্গিয়া রাজাদের বংশধর। এমনি এমনি আমি নরকাসুরের রোলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই নি' সিলভেস্টার স্ট্যালোনের স্টাইলে সিগারেট ধরিয়ে কুন্দনলাল সায়গলের স্টাইলে হাসল সুরজিৎ 'চলুন, ক্যান্টিনে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে বাকি গল্পটা বলছি। আমি কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি...'

'কেন'?

'সেটাই তো গল্প। কাল সারারাত অর্ধতন্দ্রায় ঘোড়ায় চড়ে হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়েছি… হাজার আলোকবর্ষও বলতে পারেন...'

'কেন'?

'শুধু আপনাকে পাওয়ার জন্য' ব্রেকফাস্ট টেবিলের চা থেকে ছলকে পড়ল যেন একটা রূপকথা। আরো গভীর রূপকথা ডানা মেলল কথায় কথায়। সেদিন কলেজের ক্লাস মিস হল প্রজ্ঞার। সেসময় রূপকথার গল্প চলল নেহরু পার্কের নির্জনতায়। সুরজিৎ যেন সত্যিই এক জাদুকর। এক অলৌকিক মায়ারাজ্যের অগাধ নদীর কান্ডারী যেন ও। সপ্তপর্ণের ভরে ওঠা তরুক্ষীরগন্ধের পাশে, কুসুমকোরকলোভী ভ্রমরের গুঞ্জনের পাশে, মেঘদূতের গভীরতম মন্দ্রাক্রান্তা ধ্বনির পাশে যেন অনন্তকাল ধরে এক দৃশ্যকাব্য রচনা করে চলেছে সুরজিৎ। শুরু নেই, শেষ নেই। সেই অসীম অনন্তের শ্রোতা শুধু প্রজ্ঞা।গোটা সপ্তাহে আরো তিন দিন ক্লাস মিস হল প্রজ্ঞার। হোয়্যাটস্‌ অ্যাপ আর মেসেঞ্জার ভেসে গেল চ্যাট, ভিডিও কলিং আর অডিও কলিংয়ে। দু'জনেরই ফোন হ্যাং করল বারবার। আহার-নিদ্রা ভুলে গিয়ে জীবনও হ্যাং করে রইল স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে। কল্পলোকের কুসুম বিছানো পথে হেঁটে হেঁটে কেটে গেল আরো তিনটে সপ্তাহ।

তারপর এক সন্ধেয় 'ভারত প্রেমকথা'র আলোচনা হতে হতে সুরজিৎ বলল 'আজ রাতে একটা সারপ্রাইজ আছে। ঘুমিও না যেন। একটা-দেড়টা নাগাদ মেসেজ করে শুরু হবে ব্যাপারটা' 

'একটু হিন্ট দাও'

'হিন্ট দিলে আর সারপ্রাইজ থাকে ? একটু ধৈর্য্য ধরেই দ্যাখো না ! সবুরের ফল মিঠা হয়'

রাত দেড়টার সময় চোখে সামান্য তন্দ্রা এসেছিল প্রজ্ঞার। হঠাৎ হোয়্যাটস্‌ অ্যাপে একটা ভিডিও। দু'টি রাক্ষুসে মাগুর মাছের সঙ্গমদৃশ্যের ভিডিও। কেমন গা-ঘিনঘিনে দৃশ্য। উপেক্ষা করল প্রজ্ঞা। ঠিক চার মিনিট পর আবার সুরজিতের ভিডিও মেসেজ। এবার দু'টি বিষাক্ত সাপের সঙ্গম। সামান্য বিরক্ত হয়ে প্রজ্ঞা মেসেজ করল 'এনিথিং রং ? এই ভিডিওগুলো পাঠাচ্ছ কেন' ?

'এগুলোই পাঠাব এখন থেকে'

'হোয়্যাট ? কি বলতে চাও? আর ইয়্যু ওকে'?

'অ্যাবসল্যুটলি ফাইন। সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আবার বলছি, এগুলোই পাঠাব'

'মানে'?

'মানে মাছকে আর কত খেলাব ? চার সপ্তাহ তো খেলালাম। এবার ডাঙায় তুলতে হবে...'

'মাছ ? কে মাছ ? আর ইয়্যু জোকিং ? কেমন যেন অচেনা লাগছে তোমায়' ?

'এখন যে অচেনা লাগলে হবে না, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। বড়শি এখন গেঁথে গিয়েছে আপনার মুখে। খেয়াল করে দেখো, গত চার সপ্তাহে তোমার সবকিছু উজাড় করে আমাকে দিয়ে দিয়েছো তুমি। সমস্ত পাসওয়ার্ড পর্যন্ত। এ ভুলভুলাইয়া থেকে এখন তো তুমি বেরোতে পারবে না' 

ভয়ের অতল অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে আর মেসেজ করতে পারল না প্রজ্ঞা। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনই করে বসল 'আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না, সুরজিৎ...'

'আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। রাজার সাথে প্রেম করতে চাইলে তোমাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। সেটারই আভাস দিতে চাইছিলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো। একটা মাছকে বেশীক্ষণ খেলানোর ধৈর্য্য আমার থাকে না। গত তিন বছরে এই মেডিক্যাল কলেজেরই চারটে মেয়েকে ছিবড়ে করে দিয়েছি। তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার খুব কঠিন দৈহিক সঙ্গম। প্রথমে বেশ রক্তপাত হয়। পরে মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। ছুটিতে বাড়ি ফিরে আমার নিজের বোনের সঙ্গেও তান্ত্রিক সঙ্গম করেছি প্রচুর। আমি চাই, এসব কিছুর সাথে তুমি মানিয়ে নাও...'

অতল অন্ধকারের মধ্যে মাথা ঘুরতে লাগল প্রজ্ঞার। প্রবল এক বমনেচ্ছা থরথর করে কাঁপিয়ে দিল শরীরটাকে। তার মধ্যেও স্পীকার মোডে রাখা ফোনটা থেকে স্পষ্ট শুনল 'আজ রাতে আড়াইটের সময় তোমার কাছে আসছি। পালানোর চেষ্টা কোরো না। তোমার হস্টেলের দরজার বাইরেই আমার রাজসৈন্যরা প্রস্তুত আছে। আর এটাও শুনে নাও যে, প্রশাসনিক সব স্তরে টাকা খাইয়ে আমি সবাইকে বশীভূত করে রেখেছি। তুমি তো আমার ক্ষমতা জানোই। বেগড়বাই করলে নেহেরু পার্কের পিছনে কাল সকালে একটা লাশ পাওয়া যাবে...'

হস্টেলের ঘরের ভিতর সবকিছু যেন এক ভয়ার্ত তরল অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে। বইখাতা, জামাকাপড়, প্রজ্ঞার অকালপ্রয়াত বাবামায়ের ছবিটা -সব কিছু যেন চরম শূন্য, শুষ্ক, ভয়ার্ত এক হাঁ-মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রবল এক শূন্যতার খিদে আস্তে আস্তে গা-ঘিনঘিনে করে তুলছে সব। মাত্র চল্লিশ মিনিট সময় আছে হাতে। আর দেরি করল না প্রজ্ঞা। সিলিং ফ্যানের হুকটায় শক্ত করে বেঁধে ফেলল নিজের ওড়নাটা। বাইরে তখন শারদ পূর্ণিমার ঘন জ্যোৎস্নায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। 

       

তন্ময় ধর


জন্ম - হুগলী জেলার কোন্নগর নবগ্রামে। লেখালিখির শুরু ২০০২ সালে কবিতা ক‍্যাম্পাস পত্রিকায়। নিয়মিত গল্প লিখেছেন আনন্দমেলা, দৈনিক স্টেটসম‍্যান, শুকতারা ইত্যাদিতে, কবিতা লিখেছেন দেশ, সানন্দা, কবিসম্মেলন, কৌরব ইত্যাদি পত্রিকায় এবং অসংখ্য ওয়েব ম‍্যাগে। ছড়া লিখেছেন আনন্দবাজার, কিশোর ভারতী, উদ্বোধন, গণশক্তি প্রভৃতিতে। ওয়েব-সাহিত্য জগতে ছড়ার জন‍্য পেয়েছেন "সরল দে স্মৃতি পুরস্কার"। সম্পাদনা করেন উষ্ণিক নামক মাসিক ওয়েবজিনের। এযাবৎ ছয়টি কাব‍্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...