Wednesday 17 August 2022

সংখ্যা চতুর্দশ।। ১৭ আগস্ট ২০২২ ।। বৃষ্টি বাজি ।। নূপুর গোস্বামী

 বৃষ্টি বাজি 

নূপুর গোস্বামী 


মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম ফেলুয়াডিহিতে  একদিন বেলা আটটার সময় স্বামী স্ত্রী'তে দাম্পত্যালাপ চলছিল। নিচু স্বরে প্রথমে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর পর অবশ্য কাক চিল  তিষ্ঠতে পারলে হয় !


হরেন হুঁকায় টান মেরে রাগে রাগে বললো-

আমার সাথে বাজে বকতে এসবিনি বলে দিচ্চি, এক থাপ্পড়ে মুখ এখুনি বন্ধ করে দুবো—-


ক্ষণপ্রভা স্বর আরও দু-পর্দা চড়িয়ে চেল্লালো-

খুব গতর বেড়েছে বল ?


পোড়ামুয়া মিনসে, বলি আচে তো ওই নেশা করা শুকনা হাড় কয়টা ! থাপ্পড় দিতে এলে তোকে কি পূজা করব নাকি হরে মিনসে ! ক্ষণপ্রভা দাসী যে সে মেয়া লয় ! কতাটা ভুলিসনি কিন্তু ! 


জানালার শার্সি খোলা আমার, অবহেলায় এক ফালি রোদ গড়াগড়ি খাচ্ছে সেই কখন থেকে আমার রঙিন দেওয়াল জুড়ে। বে- রঙা জীবনে চোখ ডুবিয়ে বসে আছি… চোখে পড়ছে সামনের  বড় নিমগাছটার নিচে হরেন বাউড়ির কালো হাড় জিরজিরে শরীরটা ! সে তামাকে টান মেরেই চলেছে আর স্ত্রী'র এলোপাথাড়ি দুমদাম কাজ কর্মের উন্মুক্ততায় মাঝে মাঝে ক্ষেপে উঠে গলা চড়াচ্ছে - চোপ ইতর মেয়েছেলে ! তোর বড় সাহস বেড়েচে দেকচি।


আমার শরীর লিয়ে খোঁটা দিস ? ক্ষণপ্রভা দু'পা এগিয়ে কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে গর্জালো- তোকে এখনো পিটে দিইনি এ তোর অনেক ভাগ্য ! হাড় হাভাতের পো... আমার জেবনটায় একেবারে ঘেন্না ধরিয়ে দিলে গা ! 


হরেনের জবাব যেন তৈরী - সাহস আছে তো মেরে দেকা । একেই বলে কলিকাল! নিজের সোয়ামি কে অছেদ্দা ! গালি গালাজ ! 


আরও পর্দা চড়ায় ক্ষণপ্রভা - ওরে রাজার ব্যাটা রে ! আমি বাড়ি বাড়ি বাসুন মেজে, উটুন নিকিয়ে কাপড় কেচে ধান ভেনে যা দুটো আনি - তা দিয়ে তো ওই ভুড়ুক ভুড়ুক তামাক টানচু, খেটে খেটে আমার জেবনটা হ্যাঁচোর প্যাঁচোর ! শরীলে আমার বল্ নাই, পরণে একটি কাপড় নাই… আবার মেজাজ ও দেখাচ্চে ! শেষমেশ গলার সবটুকু জোর উজাড় করে দু-পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগল ক্ষণপ্রভা আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে !


আমি চুপ করে বসে আছি। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। অতীতে মন চলে যায়। এক সময় এদের হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল, অল্প বিস্তর জমি সমেত সুন্দর একটা সংসার ছিলো ! হরেন ভাগচাষী। সারা বছরের চাল-ডালের অভাব হতো না। অনেক মানত, তাবিজ কবজ করেও ওদের সংসারে যখন সন্তান এলো না, তখন ওরা শুধু হাপিত্যেশ করেছে, কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ে করার কুপরামর্শে কখনো কান দেয়নি হরেন ! নিজের বউকে  প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসত সে। কিন্তু হঠাৎ গ্রামের কিছু লোক শহরে গিয়ে ফাটকা ব্যবসা শুরু করলো ! হরেনও দু'পয়সা বেশী কামানোর আশায় তাদের সাথে শহরমুখো হল… আগাপাশতলা না ভেবেই।


তখন থেকে পাশা পাল্টালো ! সকাল হলে দুটিতে হেসে খেলে নিজের নিজের কাজে আর বেরুতো না। আগে চাঁদের রাতে নিকোনো উঠানে ছেঁড়া চাটাই-এ বসে আঞ্চলিক গাথা-গান গাইতো বড় সুন্দর করে। নেশা ভাঙ্গে, কাঁচা পয়সায় সেই হরেন বেসুরো হল... বেপথু হল। চোখের সামনে সব পাল্টে গেল ক্রমশঃ।


ধীরে ধীরে বেলা বাড়ে। খয়েরবাগান মাঠে সূূর্যি-দেব মাথার ওপর তাপ ছাড়ছে , দূরে নিমাই ভৌমিকের পুকুরে রোজ সকালে সাঁতার কাটা পাতিহাঁসগুলো প্রত্যেক দিনের একঘেয়েমিতে ক্লান্ত হয়ে হেলেদুলে শ্যাওলা ধরা ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে প্যাঁক প্যাঁক ধ্বনিতে কোন তেপান্তরের দিকে যাত্রা করলো, সে কথা বলে গেল না! কেবল তাদের সারিবদ্ধভাবে দূরে মিলিয়ে যাওয়াটা ছবির মতো মাটিতে পড়ে রইলো ! আমি আমার নিজস্ব কাজ সেরে কৌতূহল ও প্লট সন্ধানের আশায় নিজের জায়গায় গিয়ে বসলাম আবার ।  


বেলা পড়ে আসে, রাগও পড়তে থাকে স্বামী-স্ত্রীর ! হুঁকোটা বারান্দার কোনায় ঠেকিয়ে রেখে মধ্য চল্লিশের হরেন সবে চল্লিশে পা রাখা বউ-এর মুখ থেকে তার হাতখানি নিজ হাত দিয়ে সরিয়ে বউয়ের ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে - অনাদরে অবহেলায় আমসি হওয়া মুখ খানি যত্নে মুছিয়ে দিতে দিতে বলল- আমিও কি বসে থাকি বলতো ক্ষণু ? তুই খাটিস আর আমি কি একটুও খাটিনি ? তুই চাল লিয়ে এসিস রায়দের ধান বেছে দিয়ে, আমিও তো মনডুহারির জলা থিকতে রোজ মাছ, শামুক, গেঁড়ি- গুগলিটা লিয়ে এসি তো, ক্যানে না জানি তুই আঁশ গন্ধ না হলে ভাত খেতে পারিসনি এক গালও ! আগে আমি শহর থিকতে কত রোজকার করে আনথুম ! তোর মুখে হাসি ফুটাত- কত টিপের পাতা, নকপালিশ, রঙিন ফিতা আর সেই সবুজ ডুরা শাড়ি ! তখন কি বিষ হারিয়ে এমন জল ঢোরা হয়েছিলাম আমি !


আড়চোখে স্বামী কে দেখতে লাগলো স্ত্রী। স্ত্রীর চোখের জলে ততক্ষণে স্বামীর পৌরুষ গর্ব খর্বের মুখে ! ক্ষণপ্রভা ঘেমে নেয়ে আদরে আব্দারে  অভাবে চোখের জলে বলে যেতে লাগলো- কেনে তুমি কলকাতায় গিয়ে জুয়া খেলে জমিজমা, গরু বাছুর সব শেষ করে দিলে... আমার দু'রত্তি গয়নাও ছাড়লেনি ... নইলে আমাদের এমন দিন এসতোনি ! 


ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে ক্ষণপ্রভা। একটি ঘুঘু পাখি একটানা ডেকে চলে ক্ষণপ্রভার দুঃখুর সাথে তাল মিলিয়ে। নিমগাছ ভরা ছোট সাদা ফুল। তার গন্ধের মাদকতায় নানা পতঙ্গের আসা যাওয়া অবিরাম। অলস হাওয়া পিরপির করে পাতলা শরীর নিয়ে ছুঁয়ে যায় এই পৃথিবীর তাবৎ জীব আর জড় জগৎ। 


জুয়া মানুষের আদিম আসক্তি ! মহাভারতের কাল থেকে যার শুরু ! শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়ার অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা মানুষকে নিঃস্ব করে দেয় !

এক সময় কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে  মারোয়াড়ীরা বৃষ্টি নিয়ে জুয়া বা ফাটকার প্রচলন করেছিলেন। আকাশে মেঘ দেখে বৃষ্টি হবে কি হবে না সে নিয়ে বাজি রাখা ! এই জুয়া নাকি মারোয়াড়ী সম্প্রদায়ের পুরনো সংস্কারের সাথে জড়িত। রাজস্থানের কিছু অঞ্চলে বর্ষার পরিমাণ এতটাই কম ছিল যে বৃষ্টিকে তাঁরা সৌভাগ্যসূচক  মানতেন। বৃষ্টির তীব্র প্রতীক্ষা থেকেই এই জুয়ার শুরু।


এই বাজির জনপ্রিয়তায় দূরের গ্রাম মফস্বল  থেকেও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে মানুষেরা আসতেন ভাগ্য ফেরাতে। চিরদিনের মতো শেষকালে গরীব মানুষই হতেন বেশী ক্ষতিগ্রস্ত ! নগদ অর্থ, ধন, সামান্য জমিজমা সব বাজি ধরতেন মানুষগুলো। লাভের আশায় ! কিন্তু শেষে পারিবারিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে ঘটনাটি শেষ হতো !


এরাও ছিলো এমনি একটি পরিবার। আজ বৃষ্টি বাজিতে হরেন সব হারিয়েছে ! তারপর থেকে অনটনই এদের সঙ্গী...আজ কাল এমন করেই জীবন যুদ্ধে দিন চলে তাদের। কখনো ওঠা কখনো পড়া। দিন শেষে দুঃখ ভুলে গিয়ে সব হারানো স্বামীর মঙ্গল প্রার্থনায় ঠাকুরের কুলুঙ্গীতে প্রদীপ জ্বালায় স্ত্রী। একটি লক্ষ্মী পেঁচা ঠিক এসে বসে থাকে এদের লক্ষ্মীহীন সংসারে প্রায় সন্ধ্যাতে ! যখন জারুল তলার অন্ধকার মিলিয়ে যেতে থাকে মেঠো চাঁদের কমলা আলোয়। আজও হরেন নিত্য রুটিন বানায়, কাল কোন খালে যাবে সে মাছ ধরতে ! কোন জঙ্গলে গিয়ে আঁশফল আনবে যা তার বউ এর মনের মতন ঠিক।

 

ওই তো ওরা হাসছে, ওই তো ফের আকাশে মেঘ দেখে বাজি ধরছে বিকেল চারটার মধ্যে কতখানি বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে  আসবে তাদের মাটির ঘরে... স্বামী-স্ত্রী'র মধ্যে যে জিতবে সে অপরজনের সেবায় আগামী দুটি দিন অতিবাহিত করবে ! কোন ঝগড়াঝাঁটি ছাড়াই !

 

এইভাবে রাতের কালো আঁধারে দুটি সরল নিরীহ  লেখাপড়া না জানা মানুষ সব অন্ধকার কাটিয়ে কাটিয়ে সাঁতরে এগিয়ে চলে। 


এত দুঃখেও একটি প্রশ্ন বার বার ফিরে ফিরে আসে আমার মনে— হরেনের বউ-এর এমন বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষণপ্রভা নামটি রাখলেন কে ? এতো কোন পণ্ডিত ব্যক্তি ছাড়া সম্ভবই নয়  ! এক আলোর রেখা… এক বিদ্যুৎবতী।

নূপুর গোস্বামী 

মূলত ফেসবুকেই লেখালেখি। কবিতা এবং গল্প লেখেন। অত্যন্ত দায়িত্বশীল পাঠিকা। সাম্প্রতিক লেখালেখির বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

No comments:

Post a Comment

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...