Wednesday 24 August 2022

সংখ্যা পঞ্চদশ।। ২৪ আগস্ট ২০২২ ।। এক জীবনের গল্প ।। বনশ্রী রায়

 এক জীবনের গল্প 

বনশ্রী রায়


রায়চৌধুরি বংশের প্রতিপত্তি আজ ইতিহাস ৷ দীননাথ রায়চৌধুরির পূর্বপুরুষরা উত্তরপ্রদেশের তহমিনার জমিদার ছিলেন ৷ কথিত আছে, এই বংশের রাজা রামপাল রায়চৌধুরির নামাঙ্কিত দিঘিতে একখানা বড় কষ্ঠিপাথর ডুবোনো ছিল ৷ জলের সমোচ্চশীলতার কারণে জলতল কখনো নিচে নামতো না ৷ তাই শুখা মরশুমেও প্রজাদের জলকষ্ট ছিল না ৷ এই বংশের সন্তান দীননাথ জমিদারির ঠাঁটবাঁট ছেড়ে পরিবার নিয়ে চলে আসেন বর্ধমান সদর শহরে ৷ তিনি রেলের চাকরি জোগাড় করেন ৷ দীননাথের পরিবারে স্ত্রী , একটি ছেলে আর এক মেয়ে ৷ সন্তানেরা সাধাসিধে ভাবেই বড় হয়ে উঠছিল ৷


   আমার গল্পের মূল চরিত্র অরণিকা , ডাকনাম অর্ণি , দীননাথ রায়চৌধুরির মেয়ে ৷ তার শিক্ষাদীক্ষা সরকারি স্কুলে , তারপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পার হয় ৷ অর্ণি টিউশন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাত ৷ দাদা, বহুদিন আগে একজন ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই ৷ মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না ৷ অর্ণি কিন্তু সেই দায় এড়াতে পারে নি ৷

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে অরণ্য তাকে বেশ পছন্দ করত ৷ অরণ্য ফেলোশিপ নিয়ে অষ্ট্রেলিয়ায় পড়তে গেল ৷ তারপর বহুবার ফোন আর , মেল এসেছে ৷ অর্ণিরও একটা চোরা টান ছিল অরণ্যর উপর কিন্তু বৃদ্ধ বাবা-মা'কে ছেড়ে তার পক্ষে বিদেশে সেটল করা সম্ভব নয় ৷


       বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষে একটি স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ এল৷ এরমধ্যে বাবার পছন্দ মতো পাত্রের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসা সারা ৷ নতুন পরিবেশে মানিয়ে চলার ভীষণ চেষ্টা করে অর্ণি ৷ শ্বশুরবাড়ির নিয়মকানুন বেশ অন্যরকম ঠেকত ওর কাছে ৷ শান্তন , অর্ণির স্বামী , উপরে অর্ণির ঘরে ঢুকতো না ৷ শাশুড়ি ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে পছন্দ করতেন ৷ অর্ণি অবশ্য বিশেষ আপত্তি করত না , মায়ের এই অতি স্নেহপ্রবণতা দেখে ৷ মনে পড়ত নিজের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কথা , যাঁরা হাপিত্যেশ করে সন্তানের পায়ের শব্দ শোনার আশায় দিন গুজরান করে ৷ অর্ণি ফুলশয্যার দিন থেকে জেনে এসেছে নতুন ঘরের দোর আটকাতে নেই ৷ বাড়িময় লোকজন ৷ ফিসফাস ৷ শাশুড়ি অর্ণিকেও কাছে টেনে রাখত ৷পাড়া প্রতিবেশির সঙ্গে মিশতে দিত না ৷ চাপা স্বভাবের মেয়েটি , বই পড়ে , লেখালিখি করে কাটিয়ে দিত দিনরাত ৷ বছর গড়িয়ে চলে, দেখতে দেখতে এগারোয় পড়ল শান্তন-অর্ণির বিয়ের বয়স ৷ রোজনামচা পরিবর্তনহীন ৷ ইদানিং শ্বশুরমশাই চাকরিতে অবসর নেওয়ায় অর্ণির উপর আর্থিক দায়ভার বাড়তে লাগলো ৷ অর্ণির কাছে খোলা আকাশ ছিল তার ওই স্কুলে পড়ানোর অবকাশ ৷ বাকি সময়টুকু যেন দমবন্ধ হয়ে আসতো ৷ অসহায় বৃদ্ধ মা বাবা আর অন্যদিকে বংশের আভিজাত্য ৷ শান্তন অলস প্রকৃতির মানুষ ৷ পারিবারিক ব্যবসাটুকু সামলানোর ক্ষমতাও নেই ৷ বাড়িতে বন্ধুবান্ধব , আড্ডা বসিয়ে দিনযাপনে অভ্যস্ত৷ ব্যবসা সামলায় ইয়ার-দোস্তরা ৷ ফলে একসময় মুনাফার লাভের অংশ তাদের পকেটস্থ হয়ে পড়ে ৷ অর্ণি তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না। কারণ শান্তন আর তার মধ্যে তখন বিস্তর দূরত্ব ৷ স্বামী আর স্ত্রীর মাঝে তখন ঢুকে বসে আছে অনেক মানুষ , অনেক বাদানুবাদ , হাজার তর্ক ৷ ইচ্ছে করেই অর্ণি রোজ স্কুল থেকে কাজ নিয়ে ফিরত ৷ কখনো স্বপ্ন দেখতো দুটো ছোট্ট ছোট্ট হাতের ৷ কিন্তু সময়ের নৌকোয় তারা চিরকাল ফিরতি পথে হেঁটে চলে গেছে, কোনোদিন ধরা দেয়নি।


    কিছুদিনের ছুটি নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে একবার অর্ণি বেরিয়ে পড়ল দেশ দেখতে ৷ আর সেই থেকে শুরু হল তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় ৷


        ট্যুরগাইড অর্ণি রায়চৌধুরি ৷ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা ঘুরে বেড়ায় মাসের পর মাস ৷ প্রকৃতি, মানুষ মনের ভীষণ কাছাকাছি ৷ পরিচয়ের দরজা খুলে গেল ৷ মাসিমা ,কাকিমা , দিদি ,দাদা , বৌদি — কত পরিচয় , কত সম্পর্ক ৷ তার সঙ্গে জুড়ে রইল চাকরিটুকু ধাগার মতোন ৷ জীবনের পরিসর বেড়ে যাওয়ায় অর্ণির ভিতর দুঃখগুলো ছোট ছোট হতে লাগলো ৷


  এদিকে অর্ণির শ্বশুরবাড়ির প্রবল আপত্তি নতুন পেশায় ৷ বাড়িতে রীতিমতন হম্বিতম্বি , মানসিক নির্যাতন ৷ নীরব হয়ে থাকতো যে মেয়েটি , আজ সবাক্ ৷ পাওনা গণ্ডার ঝুলিতে শূন্য ভরে কিছুতেই আর ওই বদ্ধ চারদেয়ালে ফিরতে পারবে না ৷ লড়তে হবে বাঁচবে বলেই ৷ অর্ণি জানত যে সে তার নিজের রক্ষণশীল পরিবারের কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য পাবে না ৷ একদিন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সোজা ট্রেনে চেপে বসল ৷ ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় ৷ তারপর লড়াই শুধু লড়াই , অর্থের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে ৷ দীর্ঘ বারো বছর পার হয়ে থিতু হল এক কামরা এক চিলতে নিজের ফ্ল্যাটে ৷ বছর দুয়েক আগে শান্তন ডির্ভোস চেয়েছে , অর্ণি এককথায় সই করে দিয়েছে ৷ 

 

      শান্তন নতুন করে ঘর বেঁধেছে ৷ আর অর্ণি একা পথ হাঁটতে শিখেছে ৷ লড়তে শিখেছে ৷ বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে অরণ্যের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ৷ অরণ্য দেশে ফিরেছে ৷ এখন বিলাসপুরের গ্লোবাল কলেজে অধ্যাপনা করে ৷ কলেজের এক কলিগের সঙ্গে লিভ ইন সম্পর্কে রয়েছে ৷ তবু মেসেনজারের চ্যাটে অর্ণির প্রতি এক ফেলে আসা মনকেমনের গল্প করে রোজ ৷

  

      টুকটাক কথাবার্তার ফাঁকে অরণ্য অর্ণিকে জানায় - সে দিন দুয়েকের জন্য কলকাতায় আসছে ৷ অর্ণির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেও প্রকাশ করে ৷ 


      সেদিন ছিল শনিবার ৷ স্কুলের ফিরতি পথে একখানা চাঁপা ফুল রঙের শাড়ি , হাতখোঁপা আর ছোট্ট কালো টিপ পরে সোজা কফিহাউসে অরণ্যের মুখোমুখি অর্ণি ৷ দীর্ঘদিনের অদেখার পর। অরণ্য ব্লু-ডেনিম জিন্স আর ব্ল্যাক শার্ট ৷ চশমার পাওয়ার সিলিনড্রিক্যাল ৷ বদল নামমাত্র ৷ অরণ্য একমনে অর্ণির দিকে তাকিয়ে রয়েছে ৷ কি নম্র , শান্ত ধীর সেই ছোট্টখাটো মেয়েটা ৷ চোখের নিচে কালো রঙের অস্পষ্ট ছোপ জীবনযুদ্ধের ছাপ রেখেছে ৷ কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে অরণ্য জেনে নিয়েছে অর্ণির ভাঙাচোরা গ্রাফ ৷ তবু যেন এক অবাধ্যতা টানছে অর্ণির দিকে ৷ এক সময় অরণ্য একটি জিপসি মেয়ের প্রেমের ফাঁদে পড়েছিল ৷ বন্য সৌন্দর্যের সঙ্গে বোহোমিয়ান জীবন খাপ খাওয়ানো অতো সহজসাধ্য নয় ৷ সব ছেড়েছুড়ে আবার নিজের ছন্দে ফিরে আসে ৷ পরদেশ ছেড়ে সটান স্বদেশ ৷ তারপর বিলাসপুর ৷ দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ে সাননির ৷ মেয়েটি দেহাতি , তবে শিক্ষিতা , একই কলেজে পড়ায় ৷ সাননি যেন কালো ভ্রমরি ৷ বড় বড় চোখের পাতা , সরল, অসম্ভব যৌন মাদকতা ৷ এক উচ্ছল জলস্রোত আঁচড়ে কামড়ে জড়িয়ে থাকে ৷


        অর্ণির কাছে কোনো সত্য গোপন করে না অরণ্য ৷ সাননির কথা ৷ তাদের সম্পর্ক , প্রেম , গোপন অভিসার ৷ অ্যাতো তোলপাড়ের মাঝে হঠাৎ অরণ্য অর্ণিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে ৷ অর্ণি প্রথমে মনে মনে ভারি খুশি হলেও ধীরে ধীরে সাময়িক উন্মাদনা বাষ্পের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায় ৷ জীবনের কঠিন লড়াইয়ে জিতে অর্ণি আত্মবিশ্বাসী, নিখুঁত হাতে তার বাবুইবাসা গড়েছে৷ সাজিয়েছে নিজের খুশিমতো তার আনন্দ , স্বপ্ন, বিষাদের রাত ৷ এখন আবার নতুন ভাবে জোছনা মাখতে , চাঁদ দেখতে অপারগ মন ৷ এইতো বেশ ভালো আছে ৷ সম্পর্ক গড়া ভাঙার ভিতর তীব্র জ্বালা ৷ তার চাইতে ঢের আনন্দ এই মুক্ত জীবনে৷ স্বাধীন বিচরণে ৷ ভালোবাসার ফ্রেমে ধরা পড়লে নিত্য প্রেমের ছকবন্দি খেলায় অরণ্যরা একদিন নিঃশেষ করবে অর্ণিদের ৷ হাড় মাংস সম্বল করে জিরজিরে খোলসে পড়ে থাকবে কেবল অবশেষ৷ তার চেয়ে অরণ্য বেঁচে থাক অর্ণির মনে, বন্ধুত্বের স্পর্শটুকুই বা কম কী ? 


      তখন সূর্যের মোলায়েম আলো মাখছে গোটা শহর৷ ট্রাম ছুটছে বাবুইবাসার দিকে ৷ হোর্ডিং মুখে মুখে জণাকীর্ণ আকাশ ৷ আলোর ফুলকি মন ছুঁয়ে মিশছে ব্যাসাল্টের কালো হৃদয়ে ৷ পারদের উচাটন ৷ ফ্লাওয়ার ভাসে জারবেরার জ্বর ৷ তখন কফিকাপে একলা জাগে ঠৌঁটের উষ্ণতা ৷। 

বনশ্রী রায়

ভূগোলের শিক্ষিকা। সাহিত্যচর্চা এবং বেড়াতে ভালোবাসেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশ পায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'মুঠো ভরা রোদ্দুর' এবং 'মন আর মনকথারা'।


No comments:

Post a Comment

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...