রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠী
শুভাশিস দাশ
কলপাড়ের বাসনগুলো মাজতে মাজতে মিনু বলে ওঠে - কালকে কিন্তু একটু আগে যাবো বৌদি। আমাদের গ্রুপের মিটিং আছে ।
শহরতলির কাছেই গড়কুড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় মিনুর বাড়ি । গ্রামের মহিলাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই স্বনির্ভর গোষ্ঠী । শুধু ওদেরই নয় এই পঞ্চায়েতে অনেকগুলো স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে। কোনোটা গোলাপ ফুল, কোনটা সারদা দেবী ইত্যাদি ইত্যাদি । সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে বৌদি উমা দেবী উত্তর দিলো - মাসে তোদের কটা মিটিং থাকে রে ?
ট্যাপের জলের ফোর্সটা কমিয়ে দিয়ে মিনু বলে- এটা লোন নেবার জন্য এসপেসাল মিটিং।
তুই কি লোন নিবি ?
না বৌদি । অতো লোন নিলে শুধবো কী করে ?
দুটো বাড়ির কাজ করে কোন মতে বেঁচে আছি গো । মিনু বাসনগুলো সাইড করে রাখতে রাখতে কথাগুলো বলে ।
এই নে, চা আর রুটিটা খেয়ে নে । চায়ের কাপটা আর দুটো রুটি মিনুর দিকে এগিয়ে দেয় উমা দেবী ।
মিনু মনে মনে ভাবে এ বাড়ির বৌদি সত্যিই খুব ভালো । এই তো সেইবার কী প্রচন্ড জ্বর । বৌদি কোনো কাজই করতে দিলো না । বরং নিজে হাতে রেঁধে খাইয়ে দিয়ে ওষুধ দিয়ে ছেলের জন্য খাবার দিয়ে সিটি রিকশা ডেকে বাড়ী পাঠিয়ে দিলো। চারদিন আসতে পারিনি । ফোন করে খোঁজ নিয়ে ছেলেকে ডেকে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে ।
কিরে কী ভাবছিস ?
উমা দেবীর কথায় মিনুর ঘোর কাটলো - না না কিছু না ।
শোন, কাল যদি সময় না পাস তবে এখান থেকে খেয়ে যাবি আর তোর ছেলেকে বলবি খেয়ে যাবে।
না না বৌদি, আমি সকালে সেদ্ধ ভাত করে যাবো। তোমার আর ঝামেলা করতে হবে না গো ।
এই বলে মিনু বেরিয়ে যায় ।
পঞ্চায়েতের হল ঘর ভর্তি মহিলা । অনেকেই মাস্ক পরে আসেনি । সারাদিন কুড়িটা গ্রুপের মিটিং। বিগত বছরের সব হিসাব কিতাব হবে । রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠির মহিলাদের গ্রুপ লিডার মানদা রায় । গাঁয়ের পড়াশুনা জানা মহিলা । বয়স প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই । দশ জনের গ্রুপে মানদা রায়ই সিনিয়র তাই ওকে সবাই মান্যি করে ।
কুড়ি জনের সিরিয়ালে রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সিরিয়াল সাত । ঠিক বেলা এগারোটায় মিটিং শুরু হলো । জেলা থেকে কর্ম কর্তারাও আজ এসেছেন । দিলীপ বিশ্বাস নামের একজন অফিসার প্রথমে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য নিয়ে বলতে উঠে বললেন-আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাঁরা লোন নিয়ে কোন কাজ করেন না। সরকারি সাহায্য কিন্তু মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষে দিয়ে থাকে । আমরা লক্ষ করছি লোন নেওয়া মানে ঘরে দামী আসবাবপত্র আনা আর কদিন বসে বসে মাছ-মাংস খাওয়া । এটা এবার বাদ দিতে হবে । আপনারা সবাই জানেন যে বিগত দুটো বছর করোনা ভাইরাস আমাদের মতো পরিবার গুলোকে পথে বসিয়েছে আর সেই কারণে আজকে আপনাদের লোনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে । এবারে সাবসিডিটা বাড়িয়ে দিয়েছেন সরকার । তবে আপনাদের গ্রুপের মধ্যে দু 'একটি গ্রুপ আছে যাঁরা নিজেরা অনেকটাই স্বনির্ভর হয়েছে এবং সামাজিক কাজকর্মও করছে। আমি রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই জন্য যে তাঁরা করোনা কালে তাঁদের নিজস্ব ফান্ড থেকে টাকা দিয়ে গাঁয়ের দুঃস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে ।জেলা পরিষদ থেকে আজকে এই মিটিং এ তাঁদের পুরস্কার দেয়া হবে ।
মিটিং শুরু হয়ে গেলো । বেলা তিনটে নাগাদ ডাক পড়লো রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর । মানদা রায় আজ চুলে তেলপাট্টা করে এসেছে । মিনু দিদা বলেই ডাকে মানদাকে । বললো-যাও এবার পুরস্কারটা নিয়ে এসো । বেশ তো সাজিচেন !
গ্রুপের সবাই এগিয়ে গেলো। গ্রামপ্রধান শশী ভূষণ পুরস্কারের অর্থ মূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক তুলে দিলো মানদা রায়ের হাতে ।
প্রধান সাহেব বললেন - আরো ভালো করে কাজ করেন ।
পরদিন কাজে এসে মিনু বৌদিকে লোক দেখতে বলে ।
উমা দেবী বলে-কেন রে কাজ ছেড়ে দিবি?
হ্যাঁ বৌদি, আমরা আমাদের গ্রুপের থেকে একটা
ছোট কারখানা করবো । আমাদের ভালো কাজের জন্য সরকার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েচে ।
আর লোকের বাড়ি এঁটো বাসন মাজতে হবে না। সেই ছোটবেলা থেকেই এই কষ্টে আছি । ছেলেটা বড় হচ্ছে । ওকেও এই কারখানার সাথে রাখবো ভাবছি ।
ঠিক আছে । এই বলে উমা দেবী বলেন ভালো থাকিস । সময় পেলে ঘুরে যাস ।
দেখতে দেখতে ছ'মাস কেটে গেলো । গড়কুড়া গ্রামের রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বানানো ধূপকাঠি ছড়িয়ে গেলো অনেক জায়গায়। একদিন দুপুর বেলা হঠাত্ মিনু এসে হাজির উমা দেবীর বাড়িতে।
গেট খুলতেই উমা দেবী অবাক - আরে মিনু এই দুপুর বেলা ? আয় ভিতরে আয় ।
ড্রয়িং রুমে বসে মিনু বললো বৌদি একটু জল খাবো ।
উমাদেবীর মেয়ে বৃষ্টি জল নিয়ে এসে বললো পিসি কেমন আছো ?
ভালো রে মা।
এই দুপুরে কই বেরিয়েছো ?
এখন সকালের দিকটা ধূপকাঠি দিয়ে বেড়াই আর বিকেলের দিকে কাটি বানানো, প্যাকেটিং করি। এই বলে মিনু ব্যাগ থেকে দু প্যাকেট ধূপকাঠি বের করে বৃষ্টির হাতে দিয়ে বললো-ভালো লাগলে বলিস দিয়ে যাবো ।
পাশ থেকে উমা দেবী বললো-দাম কতো রে ?
মিনু বললো-নানা এটা দিলাম । জ্বালিয়ে দেখো । প্যাকেটটি হাতে নিয়ে উমা দেবী দেখে তাতে লেখা রূপময়ী সুগন্ধি ধূপকাঠি । ভাবতে থাকে মানুষ তো এভাবেই বড় হয় । যাক এঁরা একটা বাঁচার ঠিকানা পেলো এতোদিন পর ।
এখন আর মানদা রায় তেমন ভাবে চলতে পারে না । হঠাত্ স্ট্রোক হয়ে যাওয়ায় প্রায় শয্যাশায়ী ।
ডিসেম্বরের শেষ দিক । শীত এবার জাঁকিয়ে বসেছে । বিছানায় শুয়ে সন্ধ্যের খবরে চোখ রাখতেই মানদা রায় চিত্কার করে উঠলো। ছেলের বউ বুল্টি ছুটে এলো । বললো মা-কী হয়েছে ?
ওই শোন। বুল্টি বিশেষ বিশেষ খবরের অপেক্ষা করলো। একটু পরেই শুনতে পেলো এবারের পদ্মশ্রী পাচ্ছেন কোচবিহার জেলার রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্ণধার মানদা রায় । প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁকে এই সম্মান তুলে দেবেন রাষ্ট্রপতি ।
মানদা দেবীর দু'চোখ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে জল । কত কষ্টে এই গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন মহিলাদের বুঝিয়ে গড়ে তুলেছিলাম এই দল । দশ জনের গ্রুপের সাত জনই লোকের বাড়িতে বাসন মাজতে যেত । যাক ভগবান আছেন । বালিশের পাশে রাখা গীতা তুলে বুকে রাখলেন মানদা । মনে মনে বললেন কর্ম করে যাও ফলের আশা করো না।
ফেলে আসা দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেন রূপময়ী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দলনেত্রী মানদা রায় ।
No comments:
Post a Comment