বিবস্বান
রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য
সেলুনের আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে বিবস্বান আবিষ্কার করলেন, উনি তিন মিলিমিটার বেঁটে হয়ে গেছেন। দু-মিলিমিটার হাইট কমে যাবার পর নিজেকে একটু ছোটো লাগছিল। কিন্তু, তিন মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের পতন ওনাকে আতঙ্কিত করে তুললো। তাহলে কী এই তিনদিন ধরে উনি ক্রমশ: বেঁটে হয়ে যাচ্ছেন ? সেলুনের চেয়ারে ধপ করে বসে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। এতদিন জল ঘুম, বাথরুম -ঘুম, চিন্তা-ঘুমে আক্রান্ত ছিলেন। ঘুমের মধ্যে কথারা সিগন্যাল না পেয়ে বে-লাইনে চলে যেত। স্বপ্নরা সবুজ সিগন্যাল পেয়ে হুস হুস করে ছুটতো। মন দিয়ে উনি অনেক দিন ঘুমান নি। সেলুনের চেয়ারে বসে অনেক দিন পর মন দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর মৃদু নাসিকা গর্জনের মধ্যেই মাথা, মুখ সব ন্যাড়া হয়ে গেল। যারা ভাবেন আতঙ্কে ঘুম চলে যায়, তাঁরা অবশ্যই বিবস্বানকে দেখে তাঁদের ভুল বুঝতে পারবেন।
ঘুম থেকে উঠে পরিচ্ছন্ন বিবস্বান সেলুনের নিভন্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'আমি কী বেঁটে হয়ে গেছি ? ’
নিভন্ত মনে মনে ভাবলো অপ্রিয় সত্য কথা বলে কাস্টোমার খচানোর কী দরকার ? তাই একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, 'তা আবার হয় নাকি ছ্যার ? আপনি ঝেমন ছিলেন ত্যামন আছেন। ’
এবার বিবস্বান খেপে গিয়ে কলার চেপে ধরলেন। আশেপাশের কাস্টোমার ছুটে এসে বলে, 'করেন কী ? করেন কী ? ’
নিভন্তকে আগুন চোখে টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। এখনও বিশ দিন বাকি বিবস্বানের বত্রিশ বছর হতে। এরমধ্যে
ও যদি বেঁটে হতে আরম্ভ করে প্রতিদিন এক মিলিমিটার করে, তাহলে তো...
বাড়িতে প্রমাণ সাইজের আয়নায় নিজের প্রমাণ সাইজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। এসময় বসুধার প্রবেশ।
'কী দেখছো এতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ? '
'আমি কী বেঁটে হয়ে যাচ্ছি বসুধা ? ’
বসুধা থতমত খেয়ে খুব মন দিয়ে দেখতে লাগলো।
'হ্যাঁ গো মনে হচ্ছে তো তাই। তুমি যেন একটু বেঁটে হয়ে গেছ। '
'মানুষ আবার বেঁটে হয় নাকি এ বয়সে? ও তোমার চোখের ভুল। '
'তা হবে হয়তো। তুমিই তো নিজে বললে, আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখছো...আমি অতশত বুঝি না। '
হাত মুছতে মুছতে বসুধা চলে গেল।
রাস্তায় বেরিয়ে মেঘের সাথে দেখা। মেঘকে অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। ঘাড়টা উঁচু করে মেঘের সাথে কথা বলতে বলতে, হঠাৎ ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা, 'আমাকে একটু সর্ট লাগছে ? '
মেঘ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বিবস্বানের দিকে, 'তুমি নিজেকে কেমন বুঝছো ? '
বিবস্বান হকচকিয়ে বললেন, 'ঠিক, ঠিকই তো আছি। '
'তাহলে এতো ঘাড় উঁচু করে কথা বলছো কেন ? '
'একটু ঘাড়ের ব্যায়াম আর কি', উত্তরের অপেক্ষা না করে হন হন করে হাঁটা দিলেন।
সামনেই একটা ডাক্তারের চেম্বার। কয়েকজন লোক বসে আছেন। চটপট ওখানে ঢুকে বলে উঠলেন।
'আমার একটু এমার্জেন্সি আছে ভাই। প্লিজ.. ’
চারদিকে আকুতি নিয়ে তাকালেন। একজন বলে উঠলেন, 'ডাক্তারখানায় এসেছি যখন সবার এমার্জেন্সি। '
আরেকজন বললেন, 'যেতে দিন ওনাকে'। বসে থাকা তিনজন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। দুজন চুপ করে বসে রইলেন। শুধু ঐ একজন আবার বলে উঠলেন, 'তা হয় না। '
একজন বিপ্লবীকে উপেক্ষা করে বিবস্বান ঢুকে পড়লেন ডক্টরের রুমে।
'কী সমস্যা ? '
'আমি তিন মিলিমিটার বেঁটে হয়ে গেছি।’
'মানে ? ’
'মানে আমি তিন মিলিমিটার বেঁটে হয়ে গেছি। ’
'আমি তো আপনাকে আগে দেখিনি, তাহলে বুঝবো কীভাবে আপনি বেঁটে হয়ে গেছেন ? এই দেখলাম। আবার এক সপ্তাহ পরে আসুন। তখন যদি দেখি আপনি সত্যিই বেঁটে হয়ে যাচ্ছেন তবে কিছু টেস্ট দেব। আমার ফিস পাঁচশ টাকা। বাইরে জমা করে যাবেন। ’
'আপনি কী পাতলা পায়খানার রোগীকেও একই কথা বলেন ? ’
'বুঝলাম না। '
'পাতলা পায়খানা দেখে তারপর ওষুধ দ্যান ? 'বলেই আর দাঁড়ালেন না। ফিস না দিয়েই চলে গেলেন নদীর ধারে।
বিবস্বান বসে আছেন নদীর ধারে, দেখছেন জলে কেমন ভেঙেচুরে যাচ্ছে তাঁর প্রতিবিম্ব। জলের কাছে এসে বুঝতে পারছেন, তিনি আসলে কখনও লম্বা হয়ে যান, কখনও বেঁটে,
জল বিবস্বানকে দেখছে আর বলছে , 'এতো সংলাপ কেন ? এতো সংলাপ কেন ? '
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কেউ কাউকে বোঝাতে পারছে না...
ইংরেজির শিক্ষিকা রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য কবিতা ও গদ্য রচনায় সাবলীল। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'আঁধারের বাউল গান'। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশ পায়। রঞ্জনার লেখায় তাঁর নিজস্বতা স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে।
No comments:
Post a Comment