Wednesday 1 June 2022

সংখ্যা ৩।। ১ জুন ২০২২ ।। চোখ || শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 চোখ 

শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় 

মাংসটা খারাপ দেয় না আলু হোসেন। হাট থেকে বেছে বেছে তাগদওলা খাসিগুলো ধরে আনে। আব্বার সুনামটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে। নাচিন্দা বাজারে বুড়ি বটতলার নীচে তিরিশ বছরেরও বেশিদিনের দোকান আলুর আব্বাজান আসগর হোসেনের। চালু ব্যবসা আজও চলছে। তবে আগেকার মতো সেই রমরমা বাজার বোধহয় আর নেই। সময়ে ভাটা যে কিছুটা পড়েছে বুঝতে পারে আলু, যবে থেকে অসুস্থ আব্বার জায়গাটাতে সে বসতে শুরু করেছে। একথা সত্যি, আলুর বেশ কিছু পুরনো বাঁধা খদ্দের রয়েছে... যাদের জোরে ওর মাংসের দোকান আজও দাঁড়িয়ে...বাজারে অন্য অনেকের মতো খাসি বলে ছাগল গছিয়ে খদ্দেরকে টুপি পরানোর ব্যবসা করতে সে শেখেনি; হয়তো আব্বাই শেখায় নি। খরিদ্দার বেঁধে রাখতে পরিশ্রমও কিছু কম করে না আলু। তবু সে বুঝতে পারে কোথায় যেন ভাটা আসছে একটা। আগে যে আসগরের দোকান বলতে লোকে একবাক্যে এই দোকানটাকেই বুঝতো, এখন একই নামে বাজারে আরো একটা দোকান এসে গিয়েছে। টাকা যেমন বড় পিচ্ছিল, একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত আসা কঠিন। যত দিন যাচ্ছে, চোদ্দটা দোকান চষা পিচ্ছিল খদ্দেরের সংখ্যা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বৈ কমছে না...আলুর তো তাই মনে হয়। পয়সাকে বেঁধে রাখা তখন ভারি মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়...গোটা দুই খাসি বেচে, হাটবাজারের ঋণ শোধ করে যা যেটুকু থাকে দিনমানে বেরিয়ে যেতে মুহূর্তও লাগে না। বিকেল হলে ঝিল পাড়ে চোলাইয়ের ঠেকে গলা ডুবিয়ে ঘাম ঝরানো জীবনটাকে ভুলে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তখন। নেশার ঘোর কাটলেই আবার সেই চপার হাতে পরের দিনের লড়াই। 

রবিবারের ভরা বাজারের ব্যস্ততা আজ আলু'র দোকানেও। নটার মধ্যেই গোটা দেড়েক খাসি বিক্রি হয়ে গেল। আরো দুটো ছাল ছাড়ানো আস্ত বডি ঝোলানো রয়েছে আংটার দড়িতে। সামনে পাবলিকের লাইন দেখে আলুর মনে হচ্ছিল অন্যদিনের চেয়ে তার বেচাকেনা আজ অনেকটাই বেশি। মাংস কাটতে কাটতে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নেয় আলু, দূরে মাছের বাজারের পাশে টিনের ছাউনির নীচে ছোট আসগরের দোকানের দিকে। এখন মাছি তাড়াচ্ছে। কয়েক দিন ধরে এমনই চলছে ওর। ভোরের দিকে খাসি বেচে বেলা বাড়লে ছাগল মেরে ব্যবসা করার গোপন কারসাজি লোকে আর কদ্দিন না বুঝে থাকবে ! বুঝুক, আরো বেশি করে পাবলিক বুঝুক। আর এই সুযোগে সে আরো খানিক লাভের কড়ি ঘরে আনুক। একেক সময় আলুর মনে হয়, তার যাবতীয় লড়ালড়ি বুঝি ঐ ছোট আসগরের সাথেই...যাকে সামনে থেকে দেখা যায়, সহজে ধরাও যায়। এখান থেকে মাইল দেড়েক দূরে আলসে বাজার মোড়ে গোটা দুই-তিন সরকারি দাগ নম্বর লাগানো মাংসের দোকান আছে বটে, সে নেহাৎই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। 

'আগের দিন নিলেন... কেমন মাংস ছিল দাদা?'

' সেই জন্যই তো আবার ঘুরে ফিরে তোর দোকানেই এলাম রে। '

' আমিও অনেক দিন ধরেই আপনাকে দেখি বাজারে আসা যাওয়া করতে। একদিন সেই যে আমার কাছে দর করে চলে গেলেন...ভাবলাম বলি, "মাংসটা নিয়ে গিয়ে দেখুন...ঠকবেন না..." ভাবতে ভাবতেই দেখি পরের সপ্তাহে আপনি কিনতে চলে এসেছেন। আবার আসবেন দাদা। যারা আমার থেকে বরাবর কেনে তারা জানে মালে কোনো গড়বড় হতে আমি দেবো না। আমার আব্বাও দেয়নি।'

'আরে আলসে বাজারের মোড় থেকেই তো অ্যাদ্দিন কিনতাম। তো সেদিন এক বন্ধু হঠাৎ করে বললো তোর কথা। ভাবলাম একদিন না হয় নিয়েই দেখি। আজকেও একবার উল্টোমুখো হয়েছিলাম সাইকেলটা নিয়ে। কি মনে করে আর গেলাম না আলসে বাজার। হ্যাঁ, যেমন যেমন বললাম…ঐ...ঐ ওখান থেকে কাট...।'

' আর বলতে হবে না দাদা। সেদিনকার চেয়েও ভালো জিনিস আজ দিচ্ছি। খেয়ে দেখবেন শুধু। এ লাছুয়া, দাদার জন্য চা নিয়ে আয়।'

টাকা আর পয়সায় বেশ ভারি হয়ে উঠেছে লুঙ্গির খোঁটটা। ওগুলো বের করে ছোটো টিনের সুটকেসটাতে ভরে রাখছিল আলু। ছেলে ইস্কুলে যাবে বলে মা ফেরিওলার কাছ থেকে কিনে দিয়েছিল ঐ সুটকেস। 

' কি রোজ রোজ বই খাতা বগলে করে পড়তে যাস...এখন থেকে এই বাক্সে ভরে...।'

সেই মা'ই একদিন ফাঁকি দিয়ে কোথায় চলে গেল! আব্বার সাথে সাথে মাংসের দোকানে বসা শুরু করলো আলু। তখন থেকেই পয়সার মুখ দেখা। পয়সা চেনা। মায়ের দেওয়া সুটকেস খানা হারাতে চায় না আলু। সংসারের অমূল্য ধন করে রেখেছে। পয়সার সিন্দুক। কাল থেকে আবার হয়তো খরার মুখ দেখতে হবে। তার মাঝেই একটা নয় দু-দুটো বাঁধা খদ্দের তৈরি হয়ে গেল বোধহয়। মাগ্গিগণ্ডার দিনে এটুকুই বা কম কি ! তবে ঐ বছর কয়েক ধরে তো দেখছে সে, কিভাবে বাঁধা খদ্দেরও পিছলে পিছলে যায়। বাজারই যেখানে পিছল, খদ্দের তো পিছলাবেই। আব্বাজান বলতো,' টাকা হলো বরফের মতো। যতবার ধরতে যাবি জল হয়ে যাবে।'

আব্বা টাকা ধরেছিল, রাখতে পারে নি। মালের পেছনে বেহিসাবি পয়সা উড়িয়ে, শেষবেলায় পঙ্গু হয়ে এখন বিছানায় পড়ে। এক বছর হলো লাছুয়াকে কাজে রেখেছে আলু। সঙ্গে থাকে। সাহায্য করে দেয়। পয়সার তেমন খাঁই নেই। 

সুটকেসটা থেকে অল্প কিছু টাকা চোলাই খাবার জন্য সরিয়ে রাখতে গিয়েও সরালো না আলু। আজ আর সরিয়ে কাজ নেই। যেদিন পকেটে পয়সা আসে সেদিন আর মন চায় না ঐ ঠেকে গিয়ে নাড়া বাঁধতে। মন খারাপ থাকলেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছেটা চলে যায়। তখনই ছটফট করে ওঠে সে। বিড়ি ধরালো আলু। অনেক দিন পর এতগুলো পয়সার মুখ দেখলো। ছোট আসগরের দোকানে দুৃ'জন খদ্দের দাঁড়িয়ে। কম পয়সায় ছাগল কেনার পাবলিক। বাজারে এখন শেষ বেলার খদ্দেরের আনাগোনা। তবু মন বলছে আরো জনা কয়েক কাস্টমার আসার সময় এখনো যায়নি তার দোকানে। পাশেই বটগাছের ডালের সাথে একটা রেওয়াজি খাসি আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা রয়েছে ছায়ায়, আর থেকে থেকেই ব্যা ব্যা করে উঠছে। ওকে একনাগাড়ে খাইয়ে দাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করেছে আলু। কম দিন থাকলো ওর কাছে ! মায়া পড়ে গেছে। মায়া রাখলে চলবে কি করে ? সুস্বাদু জিনিস দিতে গেলে লোককে এমনই...। 

উল্টোহাতে ড্রেনের ধারে ফুটপাথে চট পেতে বসে কুচো, চারাপোনা মাছ বিক্রি করছে ভজা আর ওর ভাই কালা। পেছনে ভাঙা পেচ্ছাবখানা। ভ্যানভেনে মাছি। দূর্গন্ধ। লুঙ্গি তুলে ছরছর করে মুতছে লাছুয়া।

— ' শালা, এই নিয়ে কবার যে ঢুকলো...মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই ভরপুর চোলাই টেনে এসেছে।'

মনে মনে একটা খিস্তি দিয়ে রামদাটা নিয়ে একাই খাসিটাকে জবাই করতে এগিয়ে যায় আলু। আর তখনই চোখটা আটকে যায় সামনের দিকে তাকিয়ে। 

টাইট একটা জামা আর হাফ স্কার্ট পরে আসছে… সোজা রাস্তা ধরে আসছে মেয়েটা। এরকমই ছোট ছোট ঝুলের পোষাক পরে বাজারে আসে। রোজই আসে। অনেক দিন ধরে আসে। যবে থেকে চোখ টাটানো শুরু করলো আলুর, তারও আগে থেকে। তখন যেতো-আসতো বাবার সঙ্গে...ফুটফুটে ছিল, ভালো লাগতো। এখন একলাই ভালো লাগে। সবসময় যে একা আসে মেয়েটা তাও নয়। একটা ঢ্যাঙা লম্বা মতো ছেলের সঙ্গে বাইকে চেপে গায়ে গা লাগিয়ে মাঝে মাঝেই ঘুরে বেড়ায় এ রাস্তা ও রাস্তা। বোধহয় ওর প্রেমিক। ছেলেটাকে চেনে আলু। ওর বাপকেও চেনে। ঝিলপারের ওদিকটায় থাকে। চোলাইয়ের ঠেকে গেলে হামেশাই বসে থাকতে দ্যাখে বাপটাকে। মালের ঘোরে একদিন কাকে যেন বলছিল,-- ' আমার ছেলে আমার কথাতে ওঠে আর বসে…ওঠে আর বসে। বলে দিয়েছি, "বন্ধুরা মিলে গল্পগুজব করবি কর…যদি কখনো মুখ দিয়ে মালের গন্ধ বেরোতে দেখি, কিমা করে রেখে দেবো...ফূর্তি মারা বেরিয়ে যাবে"।

মনে মনে ভাবে আলু, ফাঁস করে দেবে কিনা ছেলের কীর্তির কথা। ছেলেটাকে কেন জানি না সহ্য হয় না ওর। মেয়েটার জন্য সহ্য করে নিতে হয়। থাক, কি দরকার ! শেষে চপারের ভয়ে এ রাস্তা মাড়ানোই হয়তো ছেড়ে দেবে। সাথে মেয়েটাও। চপার নামের জিনিসটা রূপ বদলালে কি হতে পারে, এখনো বোধহয় ভোলেনি এ বাজারের লোকে। সে অনেক দিনের কথা। তখন সবে একা একা দোকান চালাতে শিখেছে আলু। একবার হোলির দিন দুটো উটকো ছেলে মাল খেয়ে দোকানে ঢুকে সে কি বাওয়ালি ! সামান্য কিছু খুচরো ঠেকিয়ে বলে কিনা কেজি খানেক মালের চাট প্যাকেট করে দিতে হবে। মামাবাড়ির মোয়া! বচসায় জড়িয়ে মাথা ঠিক না রাখতে পেরে ঘুঁষি পাকিয়ে এগিয়ে আসা ছেলেটার দিকে চপারটা নিয়ে মারমুখি হয়ে ধেয়ে যায় আলু। মারতে হয়তো চায়নি৷ চেয়েছিল ভয় দেখাতে। তবু শানানো ফলার একটা আগা কোনো কারণে ছুটে এসে ছেলেটার বাঁ হাতের কবজি থেকে কিছুটা মাংস খুবলে নিয়ে চলে এসেছিল...যে ঘটনা আলুকে থানা পুলিশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। তখন সদ্য নতুন দোকান দেওয়া ছোট আসগর এবং বাজারের আরো কেউ কেউ পুলিশের কাছে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে চেয়েছিল আলুকে প্যাঁচে ফেলতে। ব্যবসার ক্ষতি করতে। কিন্তু পাশে এসে দাঁড়ানোর লোকও কম ছিল না আলুর...বলা যায় তাদের সাক্ষ্যের জোরেই সে যাত্রায় নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে কোনোরকমে বেঁচে যায় সে। ছেলেগুলো সেদিনই বোধহয় চিনে নিয়েছিল তাকে। আর কোনোদিন এ মুখো হয় নি। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে আরো বেশি বিশ্বাস করতে শিখেছে আলু, লোকে তার সৎ ব্যবসার দাম দিয়েছিল বলেই আজও সে...। 

চিন্তাগুলো যেন হঠাৎই বাদল ঝড়ের মতো উড়ে চলে যায়। রাস্তা পেরিয়ে এদিকেই আসছে মেয়েটা দোকানের দিকে তাকাতে তাকাতে। সাথে বাঁকা চাউনি। মোচড়ানো ঠোঁটে অন্য কিসের ইঙ্গিত। চনমন করে ওঠে ভেতরটা আলুর! খেলাচ্ছে না তো ? হতে পারে। কবে যে তার দোকানে আসবে...! 

সামনে দিয়ে চলে গিয়েও কি মনে করে ফিরে এলো আবার। লেডি বার্ড সাইকেলটাকে রাস্তার ওধারে আমগাছের গা ঘেঁষে যে বুড়ো মুচিটা বসে আছে ওর আর এক পাশে এনে দাঁড় করালো। উঁচু নীচু খোয়াভাঙা ঢিবি রাস্তা। ঝাঁকুনিতে দুলে উঠল গায়ে গতরে শরীরটা। শানানো নজর ঘুরে বেড়ায় আলুর...চকচকে, সুঠাম পা থেকে ক্রমশ… খেলাতে চাইলে সেও খেলাতে জানে। সাইকেল রেখে এগিয়ে আসে মেয়েটা আলুর দোকানে এসে দাঁড়ায়।

আর কিছু দেখতে পায় না আলু। খদ্দের এসেছে। ভালো জিনিসটা দিতে হবে। ত্রস্ত হাতে গলার দড়িটা খুলে ছটফট করতে থাকা রেওয়াজিটাকে ছ্যাঁছরাতে ছ্যাঁছরাতে বটগাছের ঝুরির আড়ালে আগাছায় ঘেরা ঢালু জায়গাটাতে নিয়ে গিয়ে লাছুয়া আর ও মিলে পা দিয়ে দেহটাকে চেপে একেবারে মোক্ষম একটা কোপ দেয় ঘাড়ের কাছে। শেষ আর্তনাদটুকু বেরোনোর আগেই ঘুমিয়ে পড়ে প্রাণিটা। নতুন করে রক্তে লাল হয়ে ওঠে রামদাখানা। 

কাছে এগিয়ে আসে মেয়েটি, খুব কাছে। যে ছায়ায় এতক্ষণ নিঃশ্বাস নিচ্ছিল অবলা প্রাণি, সেই ছায়াটুকুতে এসে দাঁড়ায়...মাংসগুলো ভালো করে দেখে নিতে হবে যে!


শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় 

ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। পেশায় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে পার্শ্বশিক্ষক। বাংলা সাহিত্য পাঠ এবং গল্প লেখা অত্যন্ত প্রিয় কাজ। 

অলঙ্করণ শ্রী স্বর্ণেন্দু ঘোষ 



No comments:

Post a Comment

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...