Wednesday 13 July 2022

সংখ্যা নয়।। ১৩জুলাই ২০২২।।পক্ষাঘাত।।তন্ময় সরকার

পক্ষাঘাত 

তন্ময় সরকার

এখন কত রাত ? দেওয়ালের ঘড়িটা কবে সাতটা পঁচিশ বেজে বন্ধ হয়ে রয়েছে। ব্যাটারি বদলানো হয়নি। এলইডি বাল্বের আলো অসময়ে ঘুম ভাঙা চোখে নুন ছেটায়। জ্বালা ধরে ভীষণ। মাথাটা পাথরের মতো ভারী আর বিষের মতো ব্যথা। ঘামে ভিজে গিয়েছে গায়ের সাদা গেঞ্জি। তাতে রক্তের দাগ পুঁটির আঁকার খাতার পৃষ্ঠার মতো, ঘাম চুঁইয়ে গেঞ্জির সুতো বেয়ে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছে।

খাটের এক কোনায় তেরচা হয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে পুঁটি। কেন ? ওওও, পুঁটুর তো খুব জ্বর। এলইডি বাল্বের নীচেই শো-কেসটা দাঁড়িয়ে আছে, দেওয়াল ঘেঁষে। গত বছর পুজোর আগে প্লাস্টিকের খেলনা সেটিং-এর কাজ করে ওটা কিনেছিল রিম্পি। কিন্তু ওটার কাচগুলো সব ভাঙা কেন ? ভাঙা কাচ ছড়িয়ে আছে মাটির মেঝেতে। ওওও, মনে পড়েছে।


মেঝেতে লুটিয়ে আছে রিম্পি। গোঙাচ্ছে। রক্তের বালিশে মাথা। খয়েরি রঙের নাইটি রক্তে ভিজে কালো হয়ে গিয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে বাঁদিকের গাল বেয়ে কানের কোটরে জমা হয়েছে। শুকনো রক্তের দাগে মনে হচ্ছে আগের কালের মেয়েদের মতো সে নোলক পরেছে। রিম্পি কিছু বলার চেষ্টা করছে। বলতে পারছে না। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।

রিম্পির কাছে যেতে হবে। কিন্তু সারা শরীর লোহার মতো ভারী। মাথার মধ্যে কেউ হাতুড়ির ঘা মারছে। চুল থেকে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। ঝিম আসছে চোখে...

হাবড়া এক নম্বর রেল প্লাটফর্মের পিছন দিয়ে যে সরু ঢালাই রাস্তাটা চলে গিয়েছে স্টেশন রোডের দিকে, তার বাঁদিকে বস্তির ঘরেই ভুতোর বাবার চোলাইয়ের ব্যবসা। বাবার ব্যবসায় ভুতোকে সাহায্য করতে হয়, বিশেষত এই বিকেলবেলা। বাবা এখন নিজেই চুল্লু খেয়ে বেসামাল। মাঝে মাঝে শুধু চিৎকার করে মাকে গালাগাল দিচ্ছে। কাস্টোমারের প্রেসারও শুরু হয় এই বিকেল থেকে। কিন্তু আজ ভুতো ব্যবসা দেখতে পারবে না। আজ তাকে যেতে হবে মছলন্দপুর। মাঝে মাত্র একটা স্টেশন। দশ মিনিটে পৌঁছে যাবে। রিম্পি অপেক্ষা করবে। মাকে অনুরোধ করল, “আজ তুমি একটু সামলে নাও।”

মা খিঁচিয়ে উঠল, “ও পাপের ব্যবসা আমি দেখতি পারব না। শালা শুয়োরের বাচ্চা আমারে রাত দিন খিস্তি দেচ্ছে। ওর ব্যবসা আমি দেখতি যাব ক্যান ? ওরডা আমি খাই না পরি ? আর তুই কনে যাচ্ছিস ? পেরেম মারাতি যাচ্ছিস, তাই না ? ভাবতিছিস মা কিছু বুজদি পারে না ? ওই পেরেম-পিরিতি মারাও, কাজ করি খাতি হবে না !”


কথা বাড়ায় না ভুতো। রিম্পি অপেক্ষা করছে। দেরি হয়ে গিয়েছে।

মছলন্দপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকে কয়েকটা সাইকেল গ্যারেজ। তার পরের বস্তিটাই হল রিম্পিদের বস্তি। রিম্পির বাবা সুইপার। দুটো সিনেমা হল আর তিনটে স্কুলে সে সুইপারি করে। মানুষ খুব ভাল। কিন্তু হারামি হল রিম্পির দাদা। রিম্পিদের পাড়ায় গেলে নাকি ঠ্যাঙ ভাঙবে। ‘মাতালের বাচ্চা মাতাল ভুতো’র সঙ্গে নাকি ওর বোনের বিয়ে দেবে না। না, ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ঠ্যাঙ ভাঙাভাঙি হলে হবে।

কিন্তু আজ এসব ভাবতে ভাল লাগছে না। কথা মতো জ্যোতি সিনেমার সামনে এসে দাঁড়ায় ভুতো। একটু পরে রিম্পি আসে। ওরা হাঁটতে শুরু করে তিনআমতলার দিকে।

রিম্পির গা থেকে বিদেশি ফুলের গন্ধ আসছে। গত পুজোয় ভুতো গিফট দিয়েছিল এই সেন্টটা। রিম্পির লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ঝিলিক দেয়। বাঁকা চোখে তাকায় ভুতোর দিকে।

বাজারটা কাটিয়ে রিম্পি ভুতোর হাত ধরে। গায়ের মধ্যে শিরশির করে ওঠে ভুতোর। অনেকক্ষণ ধরে হাত ধরে হাঁটে ওরা। কেউ কোনও কথা বলে না। রিম্পিদের বস্তির দুটো ছেলে দেখে ফেলেছে। দেখুকগে। পিছনে গিয়ে একজন টোন কাটে, হাবড়া থেকে এসে মছলন্দপুরের মাল তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ভুতোর। পিছন ফেরে। হাত টেনে ধরে রিম্পি ফিসফিস করে, “ছেড়ে দাও !”

অন্ধকার হয়ে আসে। একটা গলির মধ্যে ঢুকে যায় দু’জনে। অন্ধকার সেখানে আরও বেশি কালো। রিম্পি এদিক-তাকিয়ে নেয়। না, কেউ দেখছে না। নিশ্চিন্ত হয়ে সে ভুতোর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ভুতো আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কবে আমাদের বিয়ে হবে ?”

রিম্পি উত্তর করে, “যেদিন তুমি বলবে।”

রিম্পির ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে আসে ভুতো। চুমু খায়। রিম্পির হাতে বাসন মাজা সাবানের গন্ধ। ভুতো বলে, “আমি তোমাকে আর লোকের বাড়ি বাসন মাজতে দেব না।”

রিম্পি কোনও কথা বলে না। ভুতোর চুলগুলো আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দেয়।...

তন্দ্রা কেটে যায় আবার। রিম্পি কি জল চাইছে গোঙিয়ে গোঙিয়ে ? নীচে নামতে হবে। কিন্তু শক্তি কোথায় ! নামার চেষ্টা করে ভুতো। দড়াম করে সে খাট থেকে মেঝেতে পড়ে যায়।

জল দিতে হবে রিম্পিকে। কিন্তু জল কোথায় ? একবার ওঠার চেষ্টা করে ভুতো। রিম্পি সমেত মেঝেটা দুলছে। এক-একটা হাতুড়ির ঘায়ে মাথা যেন ঝুঁকে যাচ্ছে। মাথাটা পাথরের মতো ভারী আর বিষের মতো ব্যথা। মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে উঠছে যন্ত্রণা।

রিম্পির কষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। লচাকে ডাকতে হবে। ও পারবে রিম্পিকে নিয়ে যেতে। লচাকে ডাকে ভুতো, “লচা... লচা...”

নিজের গলা নিজেই শোনা যায় না। রিম্পির গলার কাছে শিরাটা দপদপ করছে। আবার জল চাইছে। জল কোথায় ? নেই ? মাথাটা মাটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে নাকি ! না, নিজেকে সোজা রাখতে হবে। আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ভুতো। পড়ে যায়। রিম্পির বুকের পরে মাথাটা পড়ে।

ধুক্ ধুক্ ! রিম্পির বুকের শব্দের তালে তাল মেলায় মাথা-যন্ত্রণার দপ্‌ দপ্‌...

সে সময়টা খারাপ ছিল। পুঁটি তখন রিম্পির পেটে। বাবা নেই। মারা গিয়েছে তিন মাস। হঠাৎ একদিন থানার বড়বাবু দলবল নিয়ে এসে ধরে নিয়ে গেল ভুতোকে। অবাক ব্যাপার ! মাসিক মাসোয়ারা দিতে বাকি নেই। তাও! থানার খুপরিতে ঢুকে দেখল, সে একা নয়, বস্তির আর যারা ব্যবসা করে তারাও আছে।

আর ঠেক রাখা চলবে না। অনেক অনুরোধেও কাজ হল না। বড়বাবু সাফ জানালেন, তার কিছু করার নেই, উপরের অর্ডার। পাশে রাগে ভোম হয়ে বসে ছিল শিবু। গজগজ করল, “বুঝিস না ? আমাদের ব্যবসা করলে বড় বড় বারের কাস্টোমার কমে যাবে !”

হাবড়ায় ইতিমধ্যে পাঁচ পাঁচটা বার হয়েছে।

জরিমানা দিয়ে বারাসাত কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ভুতোরা ফিরল পরের দিন। অনেকে তার পরও লুকিয়ে ব্যবসা রেখে দিল। কিন্তু ভুতো চলে গেল নাসিকে। আঙুরের ব্যবসার লেবারের কাজে। বছরে অফ সিজিনে একবার বাড়ি আসত। অসুবিধে কিছু ছিল না, শুধু বিদেশবিভুঁইয়ে কষ্ট হত রিম্পি আর পুঁটির জন্যে। তাও মা ছিল ওদের সঙ্গে, তাই ভরসা।

একদিন মা-ও মরল। ফিরে আসতে হল ভুতোকে। কিন্তু খাবে কী ? রিম্পি লোকের বাড়ি কাজ করে কোনওমতে তিনটে পেট চালায়। ভুতো একেবারে কিছু করে না তা নয়। এদিক-সেদিক মাঝে-মাঝে লেবারের কাজ করে। কিন্তু রোজ সন্ধের চুল্লুর খরচটাই তো অনেক।

ভুতো রোজ রাতে শিবুর ঠেক থেকে ঘরে ফেরে। রিম্পি রেগে গালাগালি দেয়। ভুতোর মাথা গরম হয়ে যায়। খুবই গরম হয়ে যায়। তাই প্রায় রোজ রাতে ঝামেলা বাধে রিম্পির সঙ্গে। মা-বাবার ঝগড়া দেখে পুঁটি কাঁদে।

সকালে ভুতোর খুব মায়া হয় রিম্পির জন্যে। পুঁটি ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাড়ায় বেরিয়ে যায়। রিম্পি তাড়াহুড়ো করে ঘরের কাজ সারে। সাত সাতটা বাড়িতে কাজে যেতে হবে তাকে। মশারির মধ্যে থেকে ভুতো ডাকে, “রিম্পি !”

রিম্পি খাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। ভুতোর মুখটা সে দেখে নেয়। তার পর মুখ বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্য করে, “উঁহ ! সকাল হলে উনার যত নঙ্গ !”

“আয় না !”

“ধ্যাৎ ! আমার অনেক কাজ। তাছাড়া পুঁটি চলে আসবে এক্ষুণি। তখন ?”

রিম্পি চলে যায়।

খুব ভাল মেয়ে রিম্পি। খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে রিম্পিকে।

রিম্পি এত টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কেন ? বুকটা উঁচু হচ্ছে খুব, আর নেমে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর ? আঙুল দিয়ে রিম্পির গলার কাছে শিরার দপদপানিটা ছুঁয়ে দেখে ভুতো। খুব বেশি দপদপ করছে নাকি ? সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। রিম্পিকে জল খাওয়াতে হবে। লচাকে ডাকতে হবে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে রিম্পিকে। কিন্তু কীভাবে ? মাথাটা পাথরের মতো ভারী আর বিষের মতো ব্যথা। হাতুড়ির ঘা পড়ছে আর যন্ত্রণার টনটনানি বেড়ে যাচ্ছে। গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না। সোজা হওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। মাথাটা ধুকছে। চোখ বুজে আসছে...

এভাবে আর না। জয়গাছি সুপার মার্কেটের গোপাল পালের সঙ্গে পাকাপাকি কথা হয়েছে। ফলের লরি লোড করার কাজ করবে ভুতো।

এক সপ্তাহ হল রাগ করে মছলন্দপুর চলে গিয়েছে রিম্পি। খবর পেয়েছে ভুতো, পুঁটির খুব জ্বর। ভয় হয়। ডাক্তার সন্দেহ করেছেন ডেঙ্গি। এখন চারিদিকে ডেঙ্গিজ্বরে মারা যাচ্ছে অনেকে। রক্তের টেস্ট দিয়েছেন ডাক্তার। কিন্তু সে অনেক টাকার ব্যাপার।

আজ সকালবেলা মছলন্দপুর গিয়ে পুঁটি আর রিম্পিকে নিয়ে এসেছে ভুতো। রিম্পির খুব অভিমান। আসতে চায়নি। আবার ভেবেছে, যাবে কোথায় ?

অনেক বুঝিয়েছে ভুতো। প্রতিজ্ঞা করেছে, রিম্পির গায়ে সে আর হাত দেবে না কোনওদিন। আড়ালে নিয়ে গিয়ে অনেকদিন পর সে রিম্পিকে চুমু খেয়েছে। রিম্পি ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর বুকের উপরে মিথ্যে মিথ্যে ঘুসি মারছিল।

এবার ভুতো পাল্টে যাবে— আশা জাগে রিম্পির মনে। নাকি আবার চুল্লু খেয়ে ঝামেলা করবে ! আশঙ্কা হয়। আশা আর আশঙ্কায় দুলতে-দুলতে অসুস্থ পুঁটিকে কোলে নিয়ে ভুতোর সঙ্গে হাবড়া চলে এসেছে রিম্পি।

রিম্পির একটা ভেলভেটের ব্যাগ আছে। সোনার দোকানের ব্যাগ। রিম্পির মা পুঁটিকে এক জোড়া রুপোর তোড়া গড়ে দিয়েছিল। তোড়া আর নেই। ব্যাগটা আছে। সেই ব্যাগে পুঁটির রক্ত পরীক্ষার জন্যে সাড়ে তিনশো টাকা রেখে ভুতো গিয়েছিল জয়গাছি সুপার মার্কেটে।

সন্ধে-সন্ধে ফিরে এল ভুতো। রিম্পি জিজ্ঞেস করল, “কাজ হয়েছে আজ ?”

ভুতো জবাব দেয় না। শালা হারামি গোপাল পাল ! কথা খেলাপ করল। কাজটা দেবে বলেও দিল না। অন্য লোককে কাজে লাগিয়ে দিল। শয়তানটাকে বাগে পেলে আচ্ছা মতো ভোগাতে হবে।

রাগে সারা শরীর জ্বালা করে। দাঁতের মধ্যে শিরশির করে। কপাল্টা টিপটিপ করে ব্যথা করে। গায়ে কাঁটা দেয়। ভুতো জানে এই রোগের ওষুধ কী। রিম্পি পাশের ঘুপচি রান্নাঘরে চাল চড়িয়েছে হাড়িতে। বিছানায় পুঁটি জ্বরে বেহুঁশ। ভেলভেটের ব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে নিয়ে শিবুর ঠেকের দিকে চলে যায় ভুতো।

অনেক খেয়ে ফেলেছে আজ। অনেক। রাত এগারোটা। রিম্পি জোরে ধাক্কা দেয়, “মাতালের বাচ্চা মাতাল ! মেয়ের চিকিৎসার টাকায় মাল গিলতে লজ্জা করে না তোর ? শালা শুয়োর ! বউ মেয়েকে খাওয়ানোর মুরোদ নেই, শুধু মাল গিলতে পারিস !”

উন্মাদ হয়ে যায় ভুতো, এত বড় কথা !

“কত সাহস তোর মাগি ! আমার পয়সায় আমি মাল খাই। তোর কী ? দেখাচ্ছি, দাঁড়া !”

চুলের মুঠি ধরে এক আছাড়ে রিম্পিকে ঘর থেকে বাইরে ফেলে ভুতো। দরজার হাঁকটা তুলে নেয়। এক বাড়ি মারে শোকেসের কাচে। ঝুরঝুর করে কাচ ভেঙে পড়ে মেঝেতে। শব্দ শুনে পাড়ার লোক ছুটে আসে। রিম্পি দৌড়ে পাশের বুল্টিদের ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। সেখান থেকে রিম্পিকে হিঁচড়ে টেনে আনে ভুতো। বুল্টি বাধা দেয়। চিৎকার করে ভুতো, “এই খানকি মাগি, সাধন যখন তোরে ক্যালায়, আমরা আসি ? তুই আমাদের মধ্যে ঢুকছিস কেন, শালি ? ছাড় ওকে।”

“বাজে কথা বলবি না, ভুতো, বলে দিলাম।”

জবাব দিয়ে বুল্টি ঘরে ঢুকে যায়। রিম্পিকে টানতে-টানতে আবার ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে ভুতো। লচা ছুটে আসে, “বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু, ভুতো !”

লচার বুকে বাঁ-হাতের তালু দিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয় ভুতো। তার পর চটাস-চটাস করে নিজের বুক চাপড়ে বলে, “এই শালা, ও আমার বউ, আমার ! আমার বউকে আমি খাওয়াই। আমি মারব। তোর এত দরদ কেন ? আজ আমি ওকে মেরেই ফেলব। তার পর যদি জেলে যেতে হয় যাব। তুই ফোট্ !”

নিজের ঝুপড়ির টিনের ঝাপে দুটো ঘুসি মারে ভুতো। টিন তুবড়ে যায়। লচা আগুন চোখে তাকায়। লচার চোখের দিকে আঙুল উঁচিয়ে গর্জে ওঠে ভুতো, “তাকাচ্ছিস কী ? ফোট্ ! আজ আমার হাত থেকে শালার মাগিকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

লচা চলে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে আগুন চোখে ভুতোর দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যায়।

মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে রিম্পির। পৃথিবীর কোনও আইন, কোনও আদালতের ক্ষমতা নেই রিম্পিকে আজ বাঁচায়। ঘরের সামনের শেডের সাপোর্ট দেওয়া বাঁশ খুলে নেয় ভুতো। ভুতোর মতো লম্বা বাঁশ। ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দেয়। মেঝেতে ভয়ানক ভয়ার্ত চোখে মুণ্ডুকাটা মুরগির মতো ছটফটিয়ে কাঁপছে রিম্পি...

রিম্পির বুকটা আর কাঁপছে না। ভুতোর বুকটা কেঁপে ওঠে খুব জোরে ! গলার কাছে আঙুল দেয়। শিরাটার দপদপানিও থেমে গিয়েছে।

“মরে গেলি নাকি, রিম্পি ? মরিস না, প্লিজ মরিস না, ফিরে আয়। আয় না! তোকে খুব ভালবাসি। আর কোনওদিন মারব না তোকে। কোনওদিন না !”

রিম্পির বুকের কাছে কান চেপে ধরে ভুতো। কেঁপে উঠল কি একবার বুকটা ?

“ফিরে এলি, রিম্পি ? ফিরে এলি ?”

না। এ কাঁপুনি রিম্পির বুকের নয়। হর্ন দিয়ে পুরো বস্তিটাকে কাঁপিয়ে ফার্স্ট ট্রেন চলে গেল শিয়ালদার দিকে।

এলইডি বাল্বের বেয়াড়া আলো চোখে নুন ছেটায়। জ্বালা ধরে। চোখ বুজে রিম্পির বুকের পরে মাথা রাখে ভুতো। জ্বালা ধরা চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আর রিম্পির শুকিয়ে ওঠা রক্তে ভেজা নাইটি আবারও ভিজতে থাকে।

তন্ময় সরকার

বসবাস-- হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা। পেয়েছেন 'বহুস্বর অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি গল্প প্রতিযোগিতা-২০২০'-তে প্রথম পুরস্কার। আনন্দমেলা, সাপ্তাহিক বর্তমান, কিশোর ভারতী, আজকাল, বহুস্বর, দাঁড়াবার জায়গা, শতানীক, অবগুণ্ঠন, ইরাবতী, অপার বাংলা সহ আরও অনেক পত্রপত্রিকা ও ওয়েবজিনে ছোটগল্প ও অণুগল্প প্রকাশিত। 

1 comment:

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...