Wednesday 6 July 2022

সংখ্যা আট।।৬জুলাই২০২২ ।।শ্রাবণ ঘন গহন মোহে ।। অমিতাভ দাস

 শ্রাবণ ঘন গহন মোহে 

অমিতাভ দাস

জয়ন্ত'র রাতে ঘুম আসে না। ঘুম না আসার নানা রকম কারণ আছে। জয়ন্ত আগে ছাত্র পড়াত। করোনার মতো অতিমারী আসার পর থেকে ছাত্র কমতে কমতে এখন শূন্য। সে কখনো ভাবেনি তার ছাত্র সংখ্যা শূন্যতে গিয়ে দাঁড়াবে। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা-পয়সা এতদিনে ফুরিয়েছে। ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়াম আর জমা দিতে পারছে না। বাবা-মায়ের নিত্য অসুখ। 


    রাত হলেই দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা তার মাথায় এসে নামে। সে রোজ রাতে ভাবে আজ চোখ বুজে শান্ত চিত্তে ঘুমিয়ে পড়বে। 'এত ভেবে কী লাভ' ! সে ভাবে--'জিভ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি'। তবু বজ্জাত ঘুম তার চোখে আসে না। সারাদিন চিন্তা করতে করতে ভোর হয়ে যায়। পাখি ডাকে। খোলা জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢোকে। তখন তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে এলার্ম দিয়ে রাখে। মাত্র চার ঘন্টা ঘুমোবে। নটার সময় ঠিক উঠে যাবে এলার্মের শব্দে। অথচ রোজ এলার্ম বাজে, সে চোখ খুলে বিরক্ত হয়ে এলার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মা দু-তিনবার ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যায়। এভাবেই দিন যায়। জয়ন্ত কখনো বারোটা কখনো একটায় ঘুম থেকে ওঠে। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিজেই এককাপ চা বানিয়ে ফেসবুক নিয়ে বসে যায়। 'এই হয়েছে এক জ্বালা-- এই ফেসবুক'। রোজ ভাবে ' আজ সারাদিন ফেসবুক খুলব না' কিন্তু ঠিক খুলে ফেলে। ফেসবুকে ঢুকতেই নিউজ ফিডের নানা ছবি, খবর দেখতে দেখতে তিনটে বেজে যায়। মা বলেন, 'আমি কিন্তু খেতে দিতে পারব না, নিজে নিয়ে খেতে হবে। ' একথা শুনেই সে স্নানে যায়। মাত্র এক বালতি জলে সামান্য ডেটল ফেলে স্নান করে আসে। স্নান শেষে ঠাকুর ঘরে গিয়ে প্রার্থনা করে। কী সব মন্ত্রটন্ত্র বিড়বিড় করে পড়ে। নিজের জন্য সে কিছুই চায় না। বলে:' সবাই যেন ভালো থাকে। করোনা যেন কমে যায়। আমায় শ্রদ্ধা-ভক্তি দাও'। এইসব বলে-টলে সে একটা লাল জবা মা তারার পায়ে নিবেদন করে। 


    যা রান্না হয়। সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। সিদ্ধভাত বা ডালভাত সঙ্গে একটা ভাজা। অনেক দিন মাছ খায় না। মাংস অবিশ্যি আসে না ওদের বাড়িতে। বাবা-মা মাংস খান না। সপ্তাহে একদিন ডিম জুটে যায়। টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া জয়ন্ত'র বহুদিনের অভ্যেস।সে খবর দেখে। আজকাল খবর দেখতেও আর ভালো লাগে না। লকডাউন, ট্রেন বন্ধ, স্কুল বন্ধ, মানুষের অভাব, মানুষ রাত থেকে লাইন দিয়ে ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। এসব দুঃখের খবর জয়ন্তকে ছুঁয়ে থাকে সারাদিন। খুব কষ্ট হয়। রাগ হয় যখন শোনে কোন নায়িকা পুরোনো বরকে ছেড়ে নতুন কাকে বিয়ে করল, কোন নেতা পরকীয়া করে কালবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেল, কে আবার দল বদলে পুরোনো দলে ফিরল--এসব খুব নোংরা মনে হয়। ভয়ংকর বিরক্ত হয়।' দিন দিন সংবাদ মাধ্যমগুলো টি আর পি বাড়ানোর জন্য এসব দেখাচ্ছে! অথচ স্কুল বন্ধ, মানুষের কাজ নেই, এত অভাব, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নেই--- এসব নিয়ে প্রচার নেই কেন ? কেন্দ্র দিচ্ছে রাজ্যকে দোষ, রাজ্য কেন্দ্রকে। কোথায় বাস করছি। দীর্ঘদিন এস এস সি পরীক্ষা হয় না। চাকরি নেই। নতুন কোনো কারখানা হচ্ছে না। পুরোনো কারখানা যাও ছিল তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব দিকে কারো কোনো হুঁস নেই কেন ? '


     জয়ন্ত শেষ এস এস সিতে বসেছিল ২০১১তে তারপর আর এস এস সি তো ঠিকঠাক হলোই না। তার বয়স বেড়ে গেল। চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে। আর বসতেও পারবে না। তার এনার্জিও আর নেই। নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা প্রচুর নম্বর নিয়ে বসে আছে--চাকরি নেই। খুব অসহায় লাগে নিজেকে। কী করবে বাকি জীবন ? কীভাবে চলবে তার? 'এই তো সেদিন ডোমের চাকরির জন্য পি এইচ ডি করা ছেলেমেয়েরা নাকি এপ্লাই করেছে-- কাগজে লিখেছে। এতেই তো বোঝা যায় রাজ্যের অবস্থা। পরবর্তী প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? '


    এসব জয়ন্তর ভাবার কথা নয়। তবু ভাবে। বোকা বলেই হয়ত ভাবে।একটা সময় ছিল যখন জয়ন্তর কাছে ১০০/১৫০ ছেলেমেয়ে পড়ত। পুজোর পর আর শিক্ষক দিবসে সে ছাত্রছাত্রীদের ভালো-মন্দ খাওয়াত। আজ নিজেই ঠিক মতো খেতে পায় না। সময় মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়।


   জয়ন্ত বুঝতে পারে ওর ধনী বন্ধুরা ওকে এড়িয়ে চলে। স্কুল শিক্ষক, প্রফেসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার , আইটি সেক্টরের কর্মী বন্ধু ওর অনেক আছে। করোনার আগে সেইসব বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে সে পানশালাতে  যেত। পার্টিতে ডাকত ওরা। তখন জয়ন্তর পকেট ভর্তি টাকা ছিল। একটা বাইক ছিল। সুন্দরী প্রেমিকাও ছিল। গত দুবছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। গত মাসে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে। যেমনটা গল্পে বা সিনেমায় হয়। বেকার মানুষকে বিয়ে করল না মৃত্তিকা। করোনার মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল। হায়দ্রাবাদ সেটল হল। বর বড়ো চাকরি করে। ম্যাট্রিমনি সাইট থেকে পাত্র যোগার করেছে সে। এসবে জয়ন্ত খুব একটা দুঃখ পায়নি। কারণ দুঃখ পেতেও একটা অবকাশ দরকার। এত এত এত হতাশা আর দুঃখের মেঘ জমে আছে ওর ভেতর ঘরে যে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেল বলে শোক করার সুযোগ নেই। নিজের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ইচ্ছা শক্তিও কমছে। মৃত্তিকার বিয়ের রাতে শুয়ে শুয়ে ভেবেছে 'যাক ভালোই হল। চাপ নেই। একা হয়ে গেলাম। এই বেশ ভালো হল'। পরক্ষণেই জয়ন্তর আরেকটি সত্তা বলে উঠল,' জয়ন্ত তুমি ভীরু। পলায়নবাদী। হেরে যাওয়া একটা লোক। কাজ করো। খাটো। কিছু না পেলে জন খাটো যাও। অপদার্থ...'


        হঠাৎ যেন পৌরুষ জেগে ওঠে ওর। ভেতরে সেই সত্তার কাছে ধিক্কার পেয়ে সে ঠিক করে ' কাল সকালেই কিছু একটা করতে হবে। করতেই হবে। কোনো কাজ ছোট নয়।' সে ঠিক করে গ্রামের ভেতরে ফল নিয়ে বেচবে। অনেক দূরে চলে যাবে। কেউ চিনবে না। পরক্ষণেই মনে হয় গত উনিশ বছরে এত ছেলেমেয়েকে সে পড়িয়েছে যে কেউ না কেউ ঠিক-ই চিনে ফেলবে। বলবে 'টিউশন খুইয়ে স্যার এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফল বিক্রি করে। ছ্যা ছ্যা। না এ আমি পারব'। ওই যে স্যার শব্দের মোহ এখনো জয়ন্তকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।


    বাইকটা আর নেই। বিক্রি করে দিয়েছে। নিজেকে বোঝায় ' ভালোই হয়েছে। আজকাল তেলের যা দাম। তাছাড়া টিউশন নেই। গৃহবন্দী। ফালতু বাড়িতে বসিয়ে গাড়িটাকে নষ্ট করে কী হবে-- যা হয় ভালোর জন্য-ই হয়।'

--'তাই বলে দশ বছরের গাড়িটা বিক্রি করে দিলি!' আশ্চর্য হয় ওর মা। ' আর কখনো কিনতে পারবি ?'

--' পারব না তো। আর কিনে কী হবে! 'মৃত্তিকার কতো স্মৃতি ছিল। গাড়ির পেছনে মৃত্তিকাকে বসিয়ে জয়ন্ত উড়ে যেত। পেরিয়ে যেত কল্পনার সাত সমুদ্র তের নদী। মৃত্তিকা ওকে জাপটে ধরে থাকত।


    জয়ন্ত মৃদু হেসে মাকে বলে, 'মৃত্তিকাও নেই ওর স্মৃতিও নেই। এই বেশ ভালো হল জানো'...মা রান্নাঘরে চলে যান। আড়ালে চোখের জল মোছেন।


      সে সাইকেল চালিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। বয়স্ক ডাক্তারবাবু খুব মজার মানুষ। স্থানীয় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। হাতযশ আছে। জয়ন্তর সঙ্গে ভালো ভাব। বললেন, 'সমস্যা কী ?'

'ঘুম আসে না রাতে'। 

'আর ?'

'পেটের সমস্যা।' বলে চুপ থাকে জয়ন্ত।

'আর ?'

'হাতে-পায়ে জোর পাই না।'

'রাতে না ঘুমোলে পেট গরম হবে, হাতে পায়ে বল পাবেন না --এ আর নতুন কী ? বিয়ে করুন তো মাস্টারমশাই। একটা বিয়ে করা দরকার। সব সমস্যা কেটে যাবে'। বলে ফিচেল হাসি হাসেন।


    জয়ন্ত বলে, 'সব-ই বুঝি ডাক্তারবাবু। এই বেকারটিকে বিয়ে করবে কে ? আর বিয়ে করলেও খাওয়াবো কী !''


    তিনি বললেন,' সমস্যা গভীর। তবে বিয়ে করতে হবে। আরে মশাই এত ভাবছেন কেন, করোনা কী সারাজীবন থাকবে। শুনুন ঠাকুর বলেছেন:  চিনি জোগাবেন চিন্তামণি'।


রাতে শোয়ার পর এইসব ভাবতে থাকে সে। লকডাউনে বাইরেও খুব একটা যায় না। মাঝে মধ্যে বিকেলের পর ভূষণকাকার দোকানে গিয়ে বসে। এফ এমে ভূষণকাকা এখনো গান শোনে। মাঝে মাঝে তা জয়ন্তর বেশ ভালোই লাগে।


           এখনো কিছু জমানো টাকা আছে। তা দিয়ে সে নিজের হাত খরচ চালায়। হাত খরচ বলতে চা আর সিগারেট। সিগারেট দিনে দুটি। এখনো একটা রাজকীয় চাল বজায় রেখেছে। আগে দিনে এক প্যাকেট লাগত। 'করোনা আমার এই উপকারটা তাহলে করেছে।' মনে মনে হাসে। 


    ঘুম নেই চোখে। বাইরে বৃষ্টি পড়ে। দুদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। কম-বেশি নানা লয়ে। নানা ছন্দে।

           

অনন্ত কালের বৃষ্টি। অনন্তকালের শূন্যতায় বৃষ্টি পড়ে। বাইরে বৃষ্টি পড়ে অথচ ভিজে যায় জয়ন্ত'র বিছানা-বালিস-চাদর মায় এই নশ্বর শরীর। সে ঘরের ভিতর জল খোঁজে। কোথা থেকে এলো জল ? কীভাবে ভিজে গেল সব ? বাইরে 'শ্রাবণ ঘন গহন মোহে'...ভেতরে শ্রাবণ থাকে ? ছিল এতদিন ? শ্রাবণ তো একটা মাস। জয়ন্ত ভাবে, আমার কী...আমার ঘুম আসে না কেন ? আজ আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন ?...সে অন্ধকারে আলো জ্বালে। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ। হাওয়ায় ক্যালেন্ডারটা দোলে। মনে পড়ে 'আজ তো বাইশে শ্রাবণ। আজ তো তাঁর চলে যাওয়ার দিন। আমার ঈশ্বর এই দিনেই তো চলে গিয়েছেন। তাই তো চরাচর ভিজে যাচ্ছে শ্রাবণধারায়। '

 

 দক্ষিণের জানালাটা এখন খুলে দিয়েছে জয়ন্ত। আকাশটা মেঘে মেঘে ধূসর কালো। মেঘ ডাকছে এখন। জয়ন্ত বুকসেল্ফ থেকে গীতবিতানটা টেনে বার করে। এই বইতে মৃত্তিকার ছোঁয়া লেগে আছে। সে খুব ভালো গান গাইত। এই গানটায় এসে জয়ন্তর আঙুল আটকে গেল। লেখা আছে: ' যদি প্রেম দিলে না প্রাণে 

কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে...'


     ভোর হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। সঙ্গে নেমেছে বৃষ্টি। জয়ন্ত অনুভব করল বাইরের শ্রাবণ কখন যেন ভেতরেও চলে এসেছে আবার। তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে শ্রাবণ, তার নিজস্ব ধারায়। 


অমিতাভ দাস

অমিতাভ দাস মূলত কবি। তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি অণুগল্প , ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখেন। প্রকাশিত বই প্রায় ত্রিশটির বেশি । পেয়েছেন 'বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার, সুতরাং সাহিত্য সম্মান , কলম সাহিত্য সম্মান , কালদর্পন সাহিত্য সম্মান , টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার, অনিলা দেবী সাহিত্য পুরস্কার।

অবগুণ্ঠন সাহিত্য পত্রটির সম্পাদনা করে আসছেন ১৯৯৬ সাল থেকে । সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা লেখা প্রকাশিত হয়।

1 comment:

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...