Wednesday 29 June 2022

সংখ্যা সাত।।২৯ জুন2022।।গোবরের মা ।। ঋভু চট্টোপাধ্যায়

 গোবরের মা 

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

সকাল থেকেই পুচকুটার গা গরম, চেল্লাচ্ছেও খুব। ভুদি বহুবার ভোলাবার চেষ্টা করেছে। কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে, পাশের ঘরের সালমার কাছে গিয়ে আব্দার করে বলেছে, ‘ও বৌ, তুই একটু দুধ খাওয়া না, দেখ কেমন কাঁদছে।’ পুচকুটাকে আনার পরে কয়েকবারই তার কাছে যেতে হয়েছে। বেচারা কিছু বলে না, কিন্তু ভুদির নিজের খারাপ লাগে। ওর নিজেরও ছেলে আছে, তাকেও তো দুধ দিতে হবে। কিন্তু এই পুচকুটা তো শোনেই না। ভুদি তো একদিন নিজের বুকের শুকনো বোঁটাটাই পুচকুটার মুখে গুঁজে কান্না থামিয়ে ছিল, এছাড়া তো কিছু উপায়ও ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই মনে হল, ‘হায় ভগবান, এই বাচ্চাটাকেও ঠকাচ্ছি ?’ তারপর একটা বোতল কিনল। কাঁদলেই দুধ গুলে মুখে ধরত। কান্না থামাত, ভুদির মুখে হাসি ফুটত। পুচকুটার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করত। প্রথম কয়েকদিন কাজেও যেতে পারে নি, কিন্তু না কাজে গেলে খাবে কি ? তারপর কয়েকটা দিন যাদের ঘরে বাচ্চা ছেলে মেয়ে আছে তাদের ঘরে রেখে যেত। ভালো লাগত না, কাজের মাঝে ফিরে চলে আসতে হত, পুচকুটার জন্য মনটা কেমন করত, ভয় লাগত। মনে হত,‘এই যা, পড়ে যাবে না তো, ওরা পুচুটাকে দেখবে তো ?’

বস্তির সবাই ভুদির সামনেই হেসে বলত, ‘তুমার নিজের মনে হচে গো ? এই বয়সে কার সাথে কি করলে ?’ এমনিতে এখানে কে কার সাথে শুচ্চে বা কে কোথায় যাচ্ছে এই সব কেউ ভাবে না। কত জন রাতের অন্ধকারে রঙ মেখে বাইরে বেরোয় তার হিসাব কি কেউ রাখে ? ভুদির অবশ্য সে বয়স আর নাই, সময়ও নাই। সারাটা দিন একটা বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পর রাতেও একটা হোটেলে রুটি বেলার কাজ করে। রাতের খাওয়াটার পাশে পঞ্চাশ টাকা করে পায়। বলা যায় না, শরীর কোনদিন চলবে কোন দিন চলবে না, তখন সকালে আরেকটা কোথাও ঢোকা যাবে। কয়েকটা দিন গোবর না দেওয়াতে একদিন ঐ বৌটাও এসে জিজ্ঞেস করে। ভুদি তাকে সব কথা বলতেই সেও একটু চমকে ওঠে, ‘সত্যি বল, তুমি চুরি করে আনো নি তো, সকালে গোবর কুড়াতে গিয়ে এ কি নিয়ে এলে ?’

ভুদি কোন উত্তর না দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে, আর পুচকুটাকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে। কত দিন পর শরীরে এভাবে একটু জিয়ন এল, দিন বা রাতে পুচকুটা যখন তার পাশে শুয়ে থাকে, একটা ভালো লাগা শরীরটাকে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু এভাবে চুরির কথা আসছে শুনে ভুদির একটু মন খারাপও লাগে। চোখের সামনে ভোরের আবছা অন্ধকার নেমে আসে, ভুদি হাঁটছে, একটু দূরে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়ায়। ভুদি চমকে ওঠে।

অন্ধকার ঠেলে গলির ভিতরে ঢুকতেই তিন নম্বরের লক্ষ্মী বলে ওঠে, ‘কুথাকে গেছিলি ভুদি, বিকাল থেকে বার তিন পুলিশ এয়েছিল, তুই কি মিছা কথা বলছিস, এই নুনুট তুর কুটুমের বটে তো ?’ ভুদি কথাগুলো শুনে ভয়ে একটু কুঁকড়ে যায়। পুলিশ ! তার খোঁজে আসবেক কেনে, এমনিতে যে কাজটা করে সেটার জন্য তো পুলিশ আসার কোন ব্যাপার হবে না, তাহলে কি ? ছোটবেলায় অনেকবার পড়ে থাকা ফল, ফুল কুড়িয়েছে, কেউ তো কিছু বলে নাই। সেদিন ও তো শুধু কুড়াল, না হলে তো কুকুর বিড়ালে এক্কেবারে শেষ করে দিত। তাহলে কি খুঁজছে ? কোন রকমে একটা ছোট ঢোঁক গিলে বলে উঠল,‘না না তা কেনে, ইতো আমার বুনের মেয়ের বিটি, আমার নাতনি, উয়াকে বরে মেরি দিলেক, আমি লিয়ে এয়েছি, তুদের বলিছিলম তো।’

কথা শুনে আরো কয়েক জন ভুদিকে ঘিরে ধরে। এই বস্তিতে পুলিশ আসা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কেউ না কেউ মদ খেয়ে বউকে পেটায়, না হলে মারামারি করে, বাড়াবাড়ি হলেই পুলিশ আসে। ভুদি সব কিছু শুনে ভয় পেলেও একটু হেসে বলে ওঠে, ‘দুর, পুলিশ এলে আমার কি, আমি তো কুনু ফেরে থাকি না।’

-সে তো ঠিক, আমরাও তাই তো বললুম, উয়ারা অবিশ্যি একটা ছেলের খোঁজে এয়েছিল, হাসপাতাল থেকে কয়েকদিন আগে চুরি হয় । কে তুর খোঁজ দিয়েছিল কে জানে ? আমি মেয়ের কথা বলতে কত ঝাঁঝ ? শুধায় ‘মেয়ে, সত্যি দেখেছিস ?’ আমি বললম, হ দেখব নাই কেনে ?

ভুদি কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তুই গেছিলি কুথাকে ?’

ভুদি জড়িয়ে জড়িয়েই উত্তর দেয়, ‘ঐ যে বড় রাস্তার ডাক্তারটকে দেখাতে।’

–ও তো হুঁয়েপাতি।

-হ রে উকেই। নাতনিটর গা গরম, তাই একটু দেখাই আনলম।

শেষের কথাগুলো বলে ভুদি আর না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের সামনে এসে দরজা খোলে। এমনিতে এই বস্তিতে কেউই নিজের ঘরে তালা লাগায় না। আর তালা লাগিয়েই বা কি হবে, সব ঘরেই সমান, চুরি করে নেবার মত কিছু নাই। তবে বস্তির লোকরা মজা করে বলে, ‘চোরের ঘরকে কি আর চুরি হয় ?’

বস্তিতে কয়েকজন চুরি ছিনতাই করে। এমনকি আশে পাশের পাড়াতে কোন চুরি হলেই আগে সবাই বস্তিতে এসেই খোঁজ করে। সে সবে ভুদির কোন কথা নাই।

ভুদি ঘরের ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালে। তার টেনে আলো জ্বালানো, তাও মাসে মাসে শুধু পাখা আর আলোর জন্য গুনে গুনে তিনশ টাকা দিয়ে আসতে হয়, না দিলে তখনই বাইরে থেকে ঘরে তালা পড়ে। ভুদির আর ঝামেলা ভালো লাগে না। কাছের কোন লোকও নাই। দুই ছেলে এক মেয়ের, ছোট ছেলেও কবেই মরে গেছে, বড়ও বউকে লিয়ে পগার পার, মেয়ে জামাই ভালো নয়, কোন খোঁজ খবর নেয় না। ভুদিও কিছু ভাবে না। এই বাজারে কে কার খোঁজ রাখে, একা বাঁচলে বাপের নাম। ভুদি নিজের নিয়েই থাকে। সকালে উঠে একটা বস্তা নিয়ে বেরিয়ে যায়। এই কয়েকটা দিন অবশ্য বস্তার সাথে একটা বালতি নিচ্ছে। রাস্তাতে গোবর পেলেই তুলে নেয়। বস্তির একজন ঘুঁটে দেয়, বালতি ভর্তি থাকলে ভুদিও কিছু টাকা পায়, তার পর বস্তাতে প্লাস্টিকের বোতল, লোহা, যা পায় তুলে এনে বিক্রি করে দিব্যি টুকটুক চলে যায় ভুদির। শুধু একটু ভোরের দিকে বেরোতে হয়। আগে বেলাতেই বেরোত, কিন্তু যবে থেকে গোবর কুড়াচ্ছে বেরোনোর সময়ও পাল্টাতে হয়েছে। একটা নতুন লোক আসছে, ও আবার সাইকেলে একটা বড় প্লাস্টিকের বালতি নিয়ে ঘুরে ঘুরে গোবর কুড়ায়।

ঘরের ভিতর ঢুকে পুচুটাকে খাটিয়ার এক কোণে শোয়ায়। ডাক্তারবাবু বুকের দুধ ভালো করে খাওয়াতে বলেছেন। শোনার পর থেকে মাথায় কথাগুলো ঘুরছে। কিন্তু কোথা থেকে খাওয়াবে। নিজের মেয়েরও একটা মেয়ে আছে, এখানে আসে না, ভুদিও কোন যোগাযোগ রাখে না। কিন্তু পুলিশ এসে যদি সব শুধায়, ঠিকানা চায় ? ভুদির শরীর খারাপ লাগে, ঘামে শরীর ভিজে যায়। একটা লম্বা শ্বাসের সাথে সব ভাবনাগুলো জড়িয়ে যায়। পুচুটাকে কুড়িয়ে এনেই ভাবতে আরম্ভ করেছিল। কুড়াতে গিয়েও অনেকবার ভেবেছিল, গাড়িটা থেকে দুটো ছায়া নেমে যখন রাস্তার পাশে পুচুটাকে রাখছিল, ভুদি কিছুই বুঝতে পারে নি। ভোর রাতের অন্ধকারে এমনি কত কিছু হয়। এক বছর আগেই রাস্তার ঝোপের ধারে একটা গাড়ি থেকে একটা বস্তা ফেলতে দেখেছিল। ওরাও ভুদিকেও দেখেছিল, কিছু বলেনি। পরে শুনল একটা লাশ ফেলে গেছিল। ভয়ে কয়েকটা দিন আলো না ফুটলে বেরোত না। কিন্তু কাউকে কিছুই বলতে পারেনি। সেদিন দিব্যি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, তারপরেও কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায়, ঝোপের কাছে যেতে দেখতে পায়। আশে পাশে দেখবার চেষ্টা করে, কাউকে দেখতে পেলেই জানাবে, কিন্তু লোক নেই। কি করবে ভাবতে পারে না। বস্তিতে নিয়ে গেলে সবাই জিজ্ঞেস করবে, কি জবাব দেবে ? ফেলে চলে আসতেও মন চাইল না। তারপরেই নিজের বোতল কুড়ানোর চটের ব্যাগটার ভিতর ভরে সোজা বস্তিতে চলে আসে। রাস্তাতে হাঁটার সময়েও ভাবে, পুলিশে দিয়ে দেবে, অথবা কাউকে বিক্রি করে দেবে। ঘরে ফিরে খাটিয়াতে শোওয়াতেই কিরকম অদ্ভুত লাগে। কাদের ছেলে কে জানে, একমাস বয়স হবে। মাথা ভর্তি চুল, গা’টাও এক্কেবারে চকচক করছে, শুধু একটু কাদা লেগে ছিল। এরকম বাচ্চাকে কেউ ফেলে দেয়? এক্কেবারে পিচাশ এরা। ভুদি গরম জল করে নিজেরই একটা ছেঁড়া ত্যানা দিয়ে গা’টা ভালো করে পরিষ্কার করে। পুচকুটা যত চেল্লাচ্ছিল তত ভুদির শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। কান্নার আওয়াজে একে একে অনেকেই ভুদির ঘরের সামনে ভিড় করতে আরম্ভ করে। বস্তিতে অনেকেই এমনি ছেলেমেয়ে নিয়ে আসে। কত বড় বড় ঘরের ছেলে মেয়ে সমাজের অজান্তে এই বস্তিতে বড় হচ্ছে। এটা বস্তির অনেকেই জানে। তাও একবার জিজ্ঞেস করে। যেমন ভুদিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে কি তুমি চুরি করে আনলে?’ ভুদির চোখ মুখ শুকিয়ে যায়। কোন রকমে আমতা আমতা করে উত্তর দেয়। সেদিন অবশ্য পাশের ঘরের সালমা পুচুকে তুলে নিয়ে সবার সামনেই দুধ খাওয়াতে আরম্ভ করে। বেরোনোর সময় বলে যায়,‘কাঁদলেই আমার কাছকে নিয়ে আসবে গো, দুধ তো তুমি দিবে না।’

আরো অন্ধকার নামলে ভুদি এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকে, চিন্তায় দুচোখের পাতাগুলো এক করতে পারে না। রাতের অন্ধকারে পুচকুটাকে সেই ঝোপের মধ্যে ফেলে এলেই ভালো হত, খাক যত পারে তত কুকুর, বিড়াল সব কামড়ে ধরুক। কিন্তু তারপর ? আবার কি একা একা থাকতে পারবে ? পুচকুটা আচমকা কেঁদে উঠতেই চমকে ওঠে। কাছে যেতেই দেখে হাতে একটা মশা কামড়েছে। ভুদি সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটাতে চুন লাগিয়ে মুখে একটা বোতল ধরে। পুচকুটা মুখে বোতল নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

বাইরে কুকুর ডাকছে। এই সময়টা রোজই কুকুরের ডাক শোনা যায়, অনেকেই কাজ থেকে বাড়ি ফেরে, কুকুর ছায়াতেও ভয় পায়। ভুদি আস্তে আস্তে ওঠে। একটা পুঁটুলিতে নিজের কয়েকটা শাড়ি গুছায়, আরেকটা পুঁটুলিতে পুচুর খাবার, দুধের বোতল, গোছায়। তারপর পুচকুর কাছে এসে দেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একটা শ্বাস ফেলে ভুদি। আচ্ছা একে বড় করা যাবে না ? অনেক বড়, স্কুলে পড়বে, ঐ বড় বাড়ির ছেলেগুলোর মত চাকরি করবে, কিন্তু ততদিন নিজে বাঁচতে পারবে ? একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের মনেই হেসে ওঠে, ‘ভুদিরে তাও যদি নিজের পেটের হত ?’ না হোক গে, তুলে বাঁচিয়েছে তো, যে বাঁচায় সেও তো মা। রাস্তার ওপারের হরি মন্দিরে কীর্তন শুনতে গেছিল ভুদি, সেখানেও তো এই কথাগুলোই বলছিল। বিয়ের পর বরটা তো তিনটের জন্ম দিয়েই ফুটে গেল। তারপর এই তিনটেকে তো বড় করেছে। একজন মরে গেল সে সব আলাদা কথা, যারা বেঁচে আছে তারাও ভুদিকে দেখে না। তাছাড়া নিজের তো এখনো শরীরে ক্ষমতা আছে, লোকের ভরসাতে খাবেই বা কেন ?

ভুদি আর ভাবতে পারে না। কাঁধে দুটো ব্যাগ চাপিয়ে কোলে পুচকুটাকে নেয়। তারপর এক পা এক পা করে দরজা বন্ধ করে বস্তি থেকে বড় রাস্তায় পা রাখে। কিন্তু যাবে কোথায় ? কিছু দূর হেঁটে গেলেই রেল স্টেশন, একটা ট্রেনে চাপতে পারলেই কোন নতুন জায়গায় যাওয়া যাবে, কেউ চিনতে পারবে না, বুঝতে পারবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এত ভোরে এখানে আর কেউ ওঠে না। বড় রাস্তার বাঁদিকে হেঁটেই একদিন পুচকুটাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল, ভুদি এবার ডানদিকে চলতে আরম্ভ করে।

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

লেখালেখি শিশুকাল থেকে। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে প্রকাশিত পাড়ার দেওয়াল পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ, এরপর স্কুল ম্যাগাজিনে। বর্তমানে প্রায় নিয়মিত কবিতা ও গল্প প্রকাশ হয়।

প্রকাশিত গল্প : আনন্দবাজার রবিবাসরীয়, তথ্যকেন্দ্র, সুখী গৃহকোণ, নবকল্লোল, দেখা, মনকলম। কবিতা : দেশ, কবিসম্মেলন, কবিতাপাক্ষিক সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। 



No comments:

Post a Comment

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...