মায়াপুকুর
অনিন্দিতা মণ্ডল
পুকুরটা দিন দিন বড় হয়ে যাচ্ছে। মুকুন্দ ভেবে পায় না কি করে এমনটা হয়। যত দিন যাচ্ছে পুকুরটা চার পাঁচ বিঘৎ করে চারদিকে বেড়েই চলেছে। আগে ঘাটের ছ’টা সিঁড়ি দেখা যেত। ওপরে বাসনকোসন রেখে মা পিসিমারা দিব্যি পা ঘষত, মাথায় মাটি দিত। এখন মাত্র দুখানা সিঁড়ি জেগে থাকে। কে জানে কেমন করে হয় ! চার চারটে সিঁড়ি এখন জলের তলায়। দুপুরে চান করতে আজকাল ভয় হয়। পা পিছলে পড়লে কি হবে ? যদিও ময়না মুখ বেঁকিয়ে বলে—মরণ ! সাঁতার জানলে আবার মানষে ডোবে নাকি ? কিন্তু মুকুন্দর ভয় হয়। সাঁতার জানলেই বা। বিপদে পড়লে বুদ্ধি নাশ হয়। ও কি জানে ? কর্ণ মহারথী। তারই কিনা রথের চাকা বসে গেল ! বিপদে বুদ্ধিনাশ। সে কি আর রথ চালাতে জানত না ? অকারণে গর্তে ফেলবে কেন চাকা ? সেরকম মুকুন্দ জানলে কি হবে, গর্তে চাকা পড়ার মত আঘাটায় আটকালে কোন সমুন্দির পুত তাকে বাঁচাবে ? ময়নাটার বড্ড সবজান্তা ভাব হয়েছে। ছেলেপুলে বড় হয়েছে, মনে করেছে সব জেনে ফেলেছে। চন্দ্র সুজ্যি কেন ওঠে সেও বোধ হয় জানে। মুকুন্দ বেশি কথা বলে না তাই। ময়নাকে কিছু বললে ছেলেমেয়ের গোঁসা হয়। মা বলে সংসার মাথায় করে রেখেছে। কেন তাকে আকথা কুকথা বলা ?
চোপর দুপুরে পুকুর ধারের সুপুরি গাছগুলোর তলায় ঝোপ সরিয়ে পাকা সুপুরি কুড়িয়ে তুলছিল মুকুন্দ। ময়না গাছ জমা দেয়। কিন্তু গাছের গোড়ায় পড়ে থাকা সুপুরি সে কুড়োতে পারে। হক আছে। ওই সুপুরি কি জলে ধপ করে পড়ে যাওয়া পাকা তাল লগা দিয়ে টেনে এনে মুকুন্দ তুলে নেয়। ওই কটা ফল বেচে আর কি হয় ? তবু যা হোক বিড়ির পয়সা জুটে যায়। কিন্তু ময়না তাড়া দেয়। তাড়াতাড়ি চান সেরে উঠতে হয়। ভাত বেড়ে মুখের সামনে দেবে ময়না। আবার মুখ ঝামটাও দেবে। মুকুন্দ ওই গলা শুনলে একবার জ্বলন্ত চোখে ঘরের দিকে চায়। তক্ক করতে বয়েই গেছে।
কিন্তু আজ খুব ভাবনা হচ্ছে। গত রাতে ছেলে প্রবোধ একবার শুনিয়েছে। ভিটেমাটি জুড়ে বসে আছ, বুঝতেও চাও না এরপর কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। মুকুন্দ বুঝতে পারে। এই একটা জায়গায় ছেলেমেয়ে দুর্বল। যতক্ষণ মুকুন্দ রাজি না হবে ততক্ষণ রেহাই পাবে না তারা। মুকুন্দ ছোট বালতি করে জল তুলে সিঁড়িতে বসে চান করে নেয়। তারপর খালি বালতিতে ফলপাকুড় গুলো নিয়ে গামছা চাপা দিয়ে উঠোনে ঢোকে।
দুপুরের খাওয়া হলে ময়না জম্পেশ ঘুম দেয়। কিন্তু মুকুন্দর দিনেরাতে ঘুম নেই। দুটো চিন্তা খেয়ে ফেলছে তাকে। এক, পুকুরটা কি শেষে ভিটে জমি সব খেয়ে ফেলবে? দুই, এ পাড়ার অন্যান্য পুকুরগুলো কিন্তু বুঁজে যাচ্ছে ক্রমশ। কিভাবে এরকম ঘটনা ঘটছে সেটা মুকুন্দর মাথায় ঢুকছে না। ওর পুকুরটা এরকম হল কি করে ? জল বেড়েই চলেছে!
সন্ধ্যের ঝোঁকে মুকুন্দ ফলগুলো গামছায় বেঁধে কেষ্টর কাছে গেল। কেষ্ট দোকানে বসেছিল। একাই। কেউ কোথাও নেই। এখন কেষ্টর দোকানের সেই রমরমা নেই আর। ফ্যাক্টরিতে তালা লাগার পর থেকে বাবুদের আসাযাওয়া বন্ধ। পাড়ায় আর কটা লোক ? মুকুন্দ সুপুরি আর তাল কটা ঢেলে দিতে কেষ্ট বেজার মুখে বলল—আর আনিসনি এসব। সুপুরি তবু শুকিয়ে অদ্ধেক পাবো। তালগুলো তো ভিজে একশা। ওই ভ্যাদভ্যাদে তাল কে নেবে ? ও তুই ফিরিয়ে নে। কেষ্টর মুখের দিকে চেয়ে মুকুন্দর মায়া হয়।
বলে, আচ্ছা, সে ছাড়। তুই তাল এমনিই নে। পয়সা দিতে হবে না। কিন্তু ক’দিন হল একটা গোল বেধেছে।
--কি গোল ?
--ময়রাপাড়ার পুকুর বুঁজে গেছে শুনেছিস?
--সে তো চোখের সামনেই দেখলাম।
--দেখলি কিরকম ?
--তুই বড় ন্যাকা, মুকুন্দ। পুকুর কি ওমনি বোঁজে রে ? বোঁজানো হয়।
--কে করে এমন ?
--লোক আছে। সে জেনে তুই কি করবি ?
মুকুন্দ ভাবে। বলা ঠিক হবে ? অবিশ্যি কেষ্ট তার ন্যাংটা বেলার বন্ধু। কিছুই অজানা নেই তার। শেষে বলেই ফেলল—আমাদের পুকুরটা কেমন বেড়েই চলেছে জানিস।
কেষ্ট চোখ ছোট করে তাকায়। --তুই কি পুকুর বুঁজিয়ে ফেলতে চাস নাকি ? হারু মুকুজ্জের বিধবা বউটা রে, ওর সঙ্গে দারুণ পীরিত আছে ওই মদন দত্তর। ওই সব জমিজমা কিনে ফেলছে তড়িঘড়ি। পুকুর টুকুর সব। বলিস তো খোঁজ নিতে পারি। মুকুজ্জের বউটা আসে তো আমার দোকানে। কথা বলব ?
নিমেষে মুকুন্দ নেমে পড়ে দাওয়া থেকে। কেষ্ট এমন বদলে গেছে ? সে পুকুর বেচবে কে বলল ? পুকুর হঠাৎ যদি ভিটে খেয়ে ফেলে সেই ভয়ে ও কথাটা পেড়েছিল। কিন্তু মুকুন্দ কেষ্টর চোখে স্পষ্ট লোভ দেখতে পেল। ছেলেবেলার বন্ধু। বড্ড বুকে লাগল তার। ময়না মুখ ঝামটা দিলে, বা ছেলেপিলে কুকথা বললেও এতটা লাগে না।
এক পা এক পা করে মুকুন্দ পিছু হটে। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কেষ্টকে বলে, কাউরে বলবি নি বলে রাখলাম। এই শেষ কথা।
কেষ্ট সে কথা শোনে কিনা বুঝতে পারে না মুকুন্দ। পথে নেমে পড়ে।
সেদিন রাতে ময়না ভারি যত্ন করে খাবার দেয়। কাঠি বাটার ঝাল দিয়ে গরম ভাত। মুকুন্দ ওর মুখের দিকে চাইলে ময়না হাসল—সারাটা দিন পুকুর আর এঁদো ঝোপ নিয়ে পড়ে থাকো। হাতে পায়ে এই জলে হাজা হবে বলে রাখলাম। তা,পুকুরের মাছ কি চোখে পড়ে না ?
মুকুন্দ খেতে খেতে মুখ তুলে চাইল। টাটকা মাছের সোয়াদ মুখে লেগে আছে। --মাছ পেলি কমনে ? ময়না গম্ভীর মুখে বলল—গামছায় তুলেছি। নিজেদের পুকুরের মাছ। খাব না নাকি ?
--তুই একা তুললি ? নাকি আর কেউ ছিল ?
--কথার ছিরি দেখ না! কে থাকবে শুনি ?
--সাঁঝের বেলায় একা পুকুরে গেলি ? মাছ ধরলি ? বিশ্বেস হয় ?
--কেন হয় না শুনি ? আমার কি কম দিন হল এ ঠাঁই ?
মুকুন্দ ভাত কটা খেয়ে উঠে পড়ল। দাওয়ার এক প্রান্তে কাঁঠাল কাঠের ছোট চৌকিটা তার রাতের আশ্রয়। দালান থেকে পুকুর ও চারপাশ স্পষ্ট। রাতের আঁধারেও সে দেখতে পায়। দালানের ওধারে ঘরে তখন ময়না ছেলেমেয়ে নিয়ে খেতে বসেছে। ছেলের গলাটা কেমন যেন জড়ানো নয় ? মদ খায় নাকি ও ? মেয়ের গলায় তেজ খুব। ময়না বলছে—বাপকে এই বেলা বল। অনেক কটা টাকা দেবে। ফ্ল্যাট দেবে দুটো। দুর্দশা একেবারে ঘুচে যাবে। ছেলের গলা—ক টাকা দেবে বলেছে কিছু ? –তা ধর না কেন কাঠা পিছু পাঁচ লাখ। মেয়ের গলা তেজালো—পুকুরেই তো খেয়েছে ক কাঠা, তার কি হবে ? ময়নার সহাস্য উত্তর—ও নিয়ে ভাবিসনি। পুকুর জমি এক দর।
তারপর তিনজনে কত জল্পনা কল্পনা। ছেলের টাকার ভাগ বেশি চাই। মেয়ে না হয় বড় ফ্ল্যাট নেবে। আর ময়না ? তার কি আর অভাব রাখবে মদন দত্ত ? মুকুজ্জে বউ কেমন আছে সে কি সকলে চেয়ে দেখছে না ?
তাহলে কথাটা পাড়বে কে ? ছেলের সেই জড়ানো গলা—এখুনি বলছি। কি মনে করেছে কি ? বাপের ভিটে বলে আমাদের হক নেই নাকি ? বুড়ো সই দেবেই। নইলে কুরুক্ষেত্তর হবে। বাপ বলে মানব না, এই বলে দিলাম। ময়নার আদুরে গলা শোনা গেল—যাক গে একটা রাত। একটু খেয়ে শুয়েছে। সকাল হলে বলিস খন। মেয়ের গলাও শুনতে পায় মুকুন্দ—সেই ভালো। ছাইপাঁশ গিলে আর বাবাকে ধমকাতে যাস না।
ওঃ ! তাহলে তো পুকুর তার ভিটে গিলেই ফেলেছে ? মুকুন্দ মনে মনে হিসেব কষে। বিঘে তিনেক জমি ছিল। পাড় খেয়ে খেয়ে পুকুরটাই বিঘে দুই হয়ে গিয়েছে। এক বিঘে বাস্তু আছে। সে রাজমিস্তিরির কাজ করে এসেছে যতদিন গতর ছিল। এখন আর পারে না। ছেলে কিস্যু করে না। পারঘাটে বসে জুয়ো খেলে, মদ গেলে। মেয়েটা একটা নার্সিং হোমে আয়ার কাজ করে। মুকুন্দ যেহেতু জানে তাই আজকাল মুকুন্দর ডাক পড়ে পানা পরিষ্কার করতে। না না ভুল। কিছুকাল আগেও পানাপুকুরের জলে নেমে মুকুন্দ পানা তুলত। এখন আর ডাক আসছে না। সব জমি এখন ডাঙা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
গভীর আঁধারে তলিয়ে যেতে যেতে মুকুন্দ ভাবে, এই তার আজন্মর ভিটে। ওই পুকুর। ওতেই তো সে তার মা ঠাকুমার গন্ধ পায়। যেসব সিঁড়িগুলো ডুবে গেছে ওগুলোই তো মা, পিসিমা, ঠাকুমা, এরা। এতদিন অন্যর পুকুরে নেমে পানা টানলেও নিজেদের পুকুরে নামতে তার ভয় হত। মা যদি ডাকে ? সেও তো একটা ডুবে যাওয়া সিঁড়ি হয়ে যাবে তবে !
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে ময়না চায়ের কাপটা নিয়ে দালানে আসে। গজগজ করে—এমন বাদলায় ঘরে শোবে না কিছুতে। বদ লোক। কিন্তু চৌকির কাছে এসে ওর কথা থেমে যায়। উঃ ! কি জ্বালাতন ! এত ভোরে কোথায় গেল লোকটা ?
ময়না হাঁক দেয়—কই শুনছ ? সাড়া নেই। অগত্যা দালান থেকে নেমে উঠোন। তারপর উঠোন থেকে নেমে পুকুরপাড়। ময়না চোখ মেলে খুঁজতে থাকে। হাঁক দেয়—কোথায় গেলে তুমি ? গলাটা ভেঙে আসে। সাড়া পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত কাপটা সমেত ধপ করে বসে পড়ে পুকুরপাড়ের সিঁড়িতে। আর ঠিক তখনই ওর মনে হয়, দুটো সিঁড়ির একটা ডুবে গেছে। সে শেষ সিঁড়িতে বসে আছে। জলের দিকে চেয়ে হাত বাড়িয়ে সে ডুবে যাওয়া সিঁড়িটা ছুঁতে চায়। নীচে আলোছায়ায় অসংখ্য মুখ ভাসে। তার কম বয়সের সব আপন মুখ। মুকুন্দর মুখটাও কি সুন্দর না ?
No comments:
Post a Comment