ফুল ফোটার সময়
আশুতোষ দেবনাথ
বেশ কিছুদিন হলো টের পাচ্ছি আবহাওয়ার পরিবর্তন। বাতাস দিক পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। উত্তরের পরিবর্তে দক্ষিণ থেকে আসছে মনকেমন করা বাতাস। তাহলে কি শীত গিয়ে বসন্তের আগমন ঘটতে শুরু করেছে । হয়তো তাই হবে। শিমুল পলাশের শাখা - প্রশাখায় কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে। গাছে গাছে আমের মুকুলে মৌমাছিদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনতে পাচ্ছি। আর এ সবের জন্যে কি আমার ভিতরটা রাঙিয়ে উঠতে চাইছে।
কিন্তু কার জন্যে ? এই সময় আমার জন্য ঘরে আলো জ্বালিয়ে যার অপেক্ষায় থাকবার কথা সে তো নেই। ফাঁকা ঘরে এখন নিকষ কালো অন্ধকার। হ্যাঁ, আমাদের সেই ঝিল পাড়ে, ছোট্ট টালির শেডের ঘর। দরমার বেড়া। যার অনেক ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়তো পোষ - মাঘের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া - বাতাস। তবু সেই সময়টা আমার কাছে অন্যরকম ছিল। আমি আমার অনুভূতির ফাঁক - ফোকরগুলি ঢেকে রাখতে পেরেছি তোমার জন্যে।
আর এখন ...? সেই কাক ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক চেনা জানা পরিচিত জনের সঙ্গে দেখা - সাক্ষাৎ করেছি আবার নতুন একটা কাজের জন্য। যে করে হোক আমার উপযোগী, সে কম্পোজের কাজ হোক বা প্রুফ দেখার কাজই হোক কোথায়ও কোনো একটা কর্ম সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত আমার যে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সদরে মুদিখানার দোকানে, দুধের দোকানে, সবজির দোকানে, কাপড়ের দোকানে আমার কিছু ধার - দেনা এখনও থেকে গেছে। দেখা - সাক্ষাৎ হলে তাঁরা খুবই মার্জিত ভাবে বলে, দাদা ভালো আছেন। খবর করবেন কবে - আপনি তো সবই বোঝেন। জানি বাকি সবার মত আপনি টাকা না দিয়ে পারবেন না।
তাদের খুব শিগগিরই তাদের পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে না হলে এ ভাবে আর কতদিন পালিয়ে পালিয়ে যাতায়াত করব ?
প্রকাশন সংস্থাটা হটাৎ এভাবে বন্ধ হয়ে যাবে কখনো ভাবিনি। বেশ ভালই তো চলছিল। মালিক দীনবন্ধু মিত্র আমাদের খুবই স্বজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর " প্রগতি প্রিন্টিং অফসেট " উদ্বোধনের সময় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করেছিলেন। হ্যাঁ, তাদের উপস্থিতিতে মালিক দীনবন্ধু অনেক অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাদের সবাইকে। আমরা যারা কর্মচারী ছিলাম তাদের উদ্দেশ্যে।
তাঁর প্রতিশ্রুতি মত প্রেসটা বেশ ভালই চলছিল। উত্তরোত্তর প্রেসের আরো উন্নতি হবে এই আশা ভরসায় আমরা আমাদের ভালোবাসার ঘর - সংসার বেঁধেছিলাম। আর কি আশ্চর্য ! আমাদের ঘর বাঁধার পরই ঘটলো সেই অভাবনীয় ঘটনা। যা আমরা কখনো ভাবতে পারিনি সেটাই ঘটলো। মালিক প্রেসের কর্মচারীদের পি. এফ্ - এর সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করে প্রেসটা বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিল। তারপর থেকেই শুরু হলো অবস্থান বিক্ষোভের কর্মসূচি। সেই সঙ্গে জীবিকার চেষ্টাও। দু ' মাস না যেতেই মুদিওলা, সবজির দোকানদার, দুধের দোকানদার আরো অনেকে তাগাদা দিতে শুরু করলো। দাদা, খবর করছেন কবে ? এইভাবে টাকা ফেলে রাখলে কারবার চালাই কি করে বলুন ? এর বেশি কিছু তাঁরা আমাকে বলত না ।
তবু কেন জানি একটা আত্মসম্মান বোধের জন্য আমি ওদের সামনে যেতে পারি না।
হয়তো তুমি বলবে তোমার আবার আত্মসম্মান বোধ আছে নাকি ?
হ্যাঁ, সীমা। আমার মধ্যে এক সময়ে সব রকম অনুভুতি ছিলো। ছিল প্রেম ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা । তোমার মনে আছে সীমা, যখন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল বিজয় দা'র বাড়িতে। প্রথম দিন আমি তোমার চোখে দেখেছিলাম সাগরের গভীরতা। সেদিনের সে কথা মনে পড়লে আজও আমার ভিতরে জাগে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি ও অনুরণন। কিন্তু আজকাল কেন জানি আমার সমস্ত অনুভূতি, স্নেহ, প্রেম - ভালোবাসা, দয়া, মায়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘরে ফিরে মনে হয় সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা। কেন জানি টের পাই তোমার উপস্থিতি। আলনায় রাখা রয়েছে তোমার শাড়ী, ব্লাউজ , নাইটি । দিয়ার জামা ইত্যাদি। ওই বুঝি দিয়া ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে মা মা করে । এতসব টানা - পোড়েন - এ আলো - আঁধারের রহস্যের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হচ্ছে হয়তো ঘরে গিয়ে দেখব তুমি আলো জ্বেলে আমার অপেক্ষায় বসে আছ। তুমি যখন ছিলে তখন তো আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আলো নিয়ে অপেক্ষা করতে। এখন এই অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে বারবার মনে পড়ছে তোমার উপস্থিতি। যা আমার স্মৃতির দরজায় বারবার কড়া নেড়ে যায়।
দুই
পকেট থেকে চাবি বের করে অন্ধকারে হাত বুলিয়ে অনেক দিনের অভ্যাসে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে থমকে যাই। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে দেশলাই খুঁজে নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখি সবকিছু ঠিক আছে কি না। ছোট মোমবাতি ঘরের খুব একটা অন্ধকার দুর করতে পারে না। কোণে কোণে জমে থাকে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চলে ইদুর, আরশোলা, আরো নানা রকম পোকার দৌরাত্ম। আলো দেখে ওরা পালিয়ে গেলো অন্ধকার ঘুপচি কোণে। তারপর সব শুনশান। কেমন একটা দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতায় ধীরে ধীরে আমি ডুবে যাই। অনেকদিন আমি চুল - দাড়ি কাটাতে সেলুনে যাই না। শার্ট - প্যান্ট ময়লা। রাতের অন্ধকারে পাড়ার কুকুরগুলো আমাকে চিনতে না পেরে তেড়ে আসে। রাতে দিদির বাড়ি থেকে খেয়ে আসি । তবু এইসব চিন্তাভাবনার ঘেরাটোপে ঘুম আসে না। জেগে থেকে এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়। আমি জেগে থাকি। জেগে থেকে একটা ভারী অদ্ভুত গন্ধ টের পাই। ভারী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ।
কোথা থেকে আসছে ? এইরকম গন্ধ তো আসবার কথা না। আমি তো এতদিন যাবৎ মরা পচা ইদুর আরশোলা টিকটিকির গন্ধে অভ্যস্ত। যে গন্ধে নাক চেপে ধরে ওয়াক থু করে ফেলতে হয়। এই মিষ্টি সুগন্ধে শরীর মনে পুলক ছড়িয়ে যাচ্ছে। রক্তে দোলা দিয়ে যাচ্ছে ভালো লাগা শিহরণ। আমি অন্ধকারে উঠে গিয়ে খুঁজতে থাকি এই গন্ধ কোথা থেকে আসছে জানার জন্য। এদিক সেদিক তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথায়ও কিছু পাই না। শেষে ঘরের পিছনের দরজা খুলে আমি থমকে গেলাম।
এ কী !
অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে ঝলমল করছে টবের কামিনী ফুল গাছটা। সাদা সাদা থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে গেছে গাছের শাখা - প্রশাখায়। সাদাসাদা থোকা থোকা ফুল ফুটে ভরে রয়েছে টবে লাগানো কামিনী ফুল গাছে। কামিনী ফুল ভারী একটা হালকা মিষ্টি গন্ধে ভরা যা মনের
চোরাগলি দিয়ে ঢুকে পড়ে মনের একান্ত মণিকোঠায়।
তিন
এই রকম আগেও আমি কত কামিনী ফুলের চারা এনে টবে লাগিয়েছি। বেশিদিন বাঁচেনি । বাঁচাতে পারিনি। যা উৎসাহ উদ্দীপনা ওই শিয়ালদায় ফুলের চারা বিক্রেতার কাছ থেকে চারা কিনে এনে টবে লাগানোর পর দু ' চার দিন। পরে আর ঠিক মত জল, সার দেওয়া হয়নি। রোদ লাগানো হয়নি। অযত্নে অবহেলায় মরে গেছে। আবার কিছুদিন পরে কোথাও কোনো ফুলের চারা বিক্রেতাকে দেখলে ছুটে গেছি। একবার ব্যর্থ হয়েও আমি বারবার ছুটে গেছি ফুল ফোটানোর নেশায়।
কামিনী ফুলের চারা টবে লাগাতে দেখে সেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, কি পাগলামি করছো তুমি। কামিনী ফুলের গাছ কেউ কখনো টবে লাগায় নাকি ? কামিনী ফুলগাছ তো মাটিতে হয়, মাটিতে । আমাদের পলাশপুর বাগানে কত গাছ ছিল। ফুল ফুটলে গন্ধে গন্ধে সাপ চলে আসে, সাপ । তুমি জান না ?
আমি বলেছিলাম, এখানে সাপ আসবে কোথা থেকে এত ঘন জন বসতিতে ?
তবু তুমি বললে, লাগাতে হবে না। লাগালে আমি ফেলে দেব। সেদিন তোমার কথা না শোনাতে রেগে গিয়ে কামিনী ফুলের চারাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে। পরে আবার রাগ পড়ে গেলে নিজেই চারাটা যত্ন করে টবে লাগিয়েছিলে। শুধু লাগিয়েই থেমে থাকনি। দু - বেলা চাল ধোয়া জল দিয়েছ। সার দিয়েছ। রোদে দিয়েছ। তোমার হাতের গুণে পরম যতনে সেই কামিনী ফুল গাছ ঝাঁপিয়ে বেড়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে আমি বাড়ন্ত ডালপালা কেটে দিয়েছি। বাড়িতে কেউ এলে জিজ্ঞেস করেছে, এটা কী ফুলগাছ ? কখন ফুল ফুটবে ? এই ফুলে কী গন্ধ ছড়াবে ?
চার
তোমারও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়েছে টবের এই ফুল গাছে সত্যি কোনো দিন ফুল ফুটবে কিনা ।
তোমার সন্দেহ দুর করে আমি বলতাম, ফুল ফুটবে না মানে, একদিন ঠিকই ফুটবে। এ যে আমাদের প্রেম - ভালোবাসার গাছ। রমণীর হাতের ছোঁয়ায় এই গাছে ফুল না ফুটে পারে।
এতদিন পরে আজ সেই ফুলগাছের শাখা - প্রশাখায় অজস্র ফুল ফুটেছে। সাদা সাদা। গন্ধে গন্ধে মাতোয়ারা। দেখতে কী সুন্দর। বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি জান সীমা, কামিনী ফুলগাছের শিকড় টবের নিচ থেকে ভেদ করে মাটির গভীরে প্রবেশ করেছে। সেই কারণে তোমাকে এই চিঠি লেখা। আমি জানি তুমি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে দিয়াকে নিয়ে।
ততদিনে আমরা আবার প্রতিষ্ঠা করতে পারব আমাদের প্রকাশন সংস্থাটিকে।
হ্যাঁ, আমরা নিজেরাই।
........
আশুতোষ দেবনাথ
জন্ম : ১৯৫৪ ওপার বাংলার বাগেরহাট। সেখানে মাঠ- নদী, সবুজ- বন প্রান্তর সব কিছুই ছিল। তবুও চলে আসতে হয় দেশভাগ ও দাঙ্গার কারণে ষাটের দশকের মাঝামাঝি। উদ্বাস্তু জীবনের কঠিন টানাপোড়েনের মধ্যে লেখাপড়া শেষ না করেই জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়া। সত্তর দশকের মাঝামাঝি লেটার প্রেসে কম্পোজিটরের কাজ করার সময়ে প্রথম গল্প
" বোধনের সময়" ক্রান্তিক পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে ছোটোগল্প লেখা শুরু। পরবর্তী কালে কলকাতার প্রায় সমস্ত পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। " জীবন জীবিতের", "অন্য রণভূমি" উল্লেখযোগ্য গল্প গ্রন্থ।
No comments:
Post a Comment