Wednesday 29 June 2022

সংখ্যা সাত।।২৯ জুন2022।।গোবরের মা ।। ঋভু চট্টোপাধ্যায়

 গোবরের মা 

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

সকাল থেকেই পুচকুটার গা গরম, চেল্লাচ্ছেও খুব। ভুদি বহুবার ভোলাবার চেষ্টা করেছে। কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে, পাশের ঘরের সালমার কাছে গিয়ে আব্দার করে বলেছে, ‘ও বৌ, তুই একটু দুধ খাওয়া না, দেখ কেমন কাঁদছে।’ পুচকুটাকে আনার পরে কয়েকবারই তার কাছে যেতে হয়েছে। বেচারা কিছু বলে না, কিন্তু ভুদির নিজের খারাপ লাগে। ওর নিজেরও ছেলে আছে, তাকেও তো দুধ দিতে হবে। কিন্তু এই পুচকুটা তো শোনেই না। ভুদি তো একদিন নিজের বুকের শুকনো বোঁটাটাই পুচকুটার মুখে গুঁজে কান্না থামিয়ে ছিল, এছাড়া তো কিছু উপায়ও ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই মনে হল, ‘হায় ভগবান, এই বাচ্চাটাকেও ঠকাচ্ছি ?’ তারপর একটা বোতল কিনল। কাঁদলেই দুধ গুলে মুখে ধরত। কান্না থামাত, ভুদির মুখে হাসি ফুটত। পুচকুটার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করত। প্রথম কয়েকদিন কাজেও যেতে পারে নি, কিন্তু না কাজে গেলে খাবে কি ? তারপর কয়েকটা দিন যাদের ঘরে বাচ্চা ছেলে মেয়ে আছে তাদের ঘরে রেখে যেত। ভালো লাগত না, কাজের মাঝে ফিরে চলে আসতে হত, পুচকুটার জন্য মনটা কেমন করত, ভয় লাগত। মনে হত,‘এই যা, পড়ে যাবে না তো, ওরা পুচুটাকে দেখবে তো ?’

বস্তির সবাই ভুদির সামনেই হেসে বলত, ‘তুমার নিজের মনে হচে গো ? এই বয়সে কার সাথে কি করলে ?’ এমনিতে এখানে কে কার সাথে শুচ্চে বা কে কোথায় যাচ্ছে এই সব কেউ ভাবে না। কত জন রাতের অন্ধকারে রঙ মেখে বাইরে বেরোয় তার হিসাব কি কেউ রাখে ? ভুদির অবশ্য সে বয়স আর নাই, সময়ও নাই। সারাটা দিন একটা বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পর রাতেও একটা হোটেলে রুটি বেলার কাজ করে। রাতের খাওয়াটার পাশে পঞ্চাশ টাকা করে পায়। বলা যায় না, শরীর কোনদিন চলবে কোন দিন চলবে না, তখন সকালে আরেকটা কোথাও ঢোকা যাবে। কয়েকটা দিন গোবর না দেওয়াতে একদিন ঐ বৌটাও এসে জিজ্ঞেস করে। ভুদি তাকে সব কথা বলতেই সেও একটু চমকে ওঠে, ‘সত্যি বল, তুমি চুরি করে আনো নি তো, সকালে গোবর কুড়াতে গিয়ে এ কি নিয়ে এলে ?’

ভুদি কোন উত্তর না দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে, আর পুচকুটাকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে। কত দিন পর শরীরে এভাবে একটু জিয়ন এল, দিন বা রাতে পুচকুটা যখন তার পাশে শুয়ে থাকে, একটা ভালো লাগা শরীরটাকে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু এভাবে চুরির কথা আসছে শুনে ভুদির একটু মন খারাপও লাগে। চোখের সামনে ভোরের আবছা অন্ধকার নেমে আসে, ভুদি হাঁটছে, একটু দূরে একটা বড় গাড়ি এসে দাঁড়ায়। ভুদি চমকে ওঠে।

অন্ধকার ঠেলে গলির ভিতরে ঢুকতেই তিন নম্বরের লক্ষ্মী বলে ওঠে, ‘কুথাকে গেছিলি ভুদি, বিকাল থেকে বার তিন পুলিশ এয়েছিল, তুই কি মিছা কথা বলছিস, এই নুনুট তুর কুটুমের বটে তো ?’ ভুদি কথাগুলো শুনে ভয়ে একটু কুঁকড়ে যায়। পুলিশ ! তার খোঁজে আসবেক কেনে, এমনিতে যে কাজটা করে সেটার জন্য তো পুলিশ আসার কোন ব্যাপার হবে না, তাহলে কি ? ছোটবেলায় অনেকবার পড়ে থাকা ফল, ফুল কুড়িয়েছে, কেউ তো কিছু বলে নাই। সেদিন ও তো শুধু কুড়াল, না হলে তো কুকুর বিড়ালে এক্কেবারে শেষ করে দিত। তাহলে কি খুঁজছে ? কোন রকমে একটা ছোট ঢোঁক গিলে বলে উঠল,‘না না তা কেনে, ইতো আমার বুনের মেয়ের বিটি, আমার নাতনি, উয়াকে বরে মেরি দিলেক, আমি লিয়ে এয়েছি, তুদের বলিছিলম তো।’

কথা শুনে আরো কয়েক জন ভুদিকে ঘিরে ধরে। এই বস্তিতে পুলিশ আসা অবশ্য নতুন কিছু নয়। কেউ না কেউ মদ খেয়ে বউকে পেটায়, না হলে মারামারি করে, বাড়াবাড়ি হলেই পুলিশ আসে। ভুদি সব কিছু শুনে ভয় পেলেও একটু হেসে বলে ওঠে, ‘দুর, পুলিশ এলে আমার কি, আমি তো কুনু ফেরে থাকি না।’

-সে তো ঠিক, আমরাও তাই তো বললুম, উয়ারা অবিশ্যি একটা ছেলের খোঁজে এয়েছিল, হাসপাতাল থেকে কয়েকদিন আগে চুরি হয় । কে তুর খোঁজ দিয়েছিল কে জানে ? আমি মেয়ের কথা বলতে কত ঝাঁঝ ? শুধায় ‘মেয়ে, সত্যি দেখেছিস ?’ আমি বললম, হ দেখব নাই কেনে ?

ভুদি কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তুই গেছিলি কুথাকে ?’

ভুদি জড়িয়ে জড়িয়েই উত্তর দেয়, ‘ঐ যে বড় রাস্তার ডাক্তারটকে দেখাতে।’

–ও তো হুঁয়েপাতি।

-হ রে উকেই। নাতনিটর গা গরম, তাই একটু দেখাই আনলম।

শেষের কথাগুলো বলে ভুদি আর না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের সামনে এসে দরজা খোলে। এমনিতে এই বস্তিতে কেউই নিজের ঘরে তালা লাগায় না। আর তালা লাগিয়েই বা কি হবে, সব ঘরেই সমান, চুরি করে নেবার মত কিছু নাই। তবে বস্তির লোকরা মজা করে বলে, ‘চোরের ঘরকে কি আর চুরি হয় ?’

বস্তিতে কয়েকজন চুরি ছিনতাই করে। এমনকি আশে পাশের পাড়াতে কোন চুরি হলেই আগে সবাই বস্তিতে এসেই খোঁজ করে। সে সবে ভুদির কোন কথা নাই।

ভুদি ঘরের ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালে। তার টেনে আলো জ্বালানো, তাও মাসে মাসে শুধু পাখা আর আলোর জন্য গুনে গুনে তিনশ টাকা দিয়ে আসতে হয়, না দিলে তখনই বাইরে থেকে ঘরে তালা পড়ে। ভুদির আর ঝামেলা ভালো লাগে না। কাছের কোন লোকও নাই। দুই ছেলে এক মেয়ের, ছোট ছেলেও কবেই মরে গেছে, বড়ও বউকে লিয়ে পগার পার, মেয়ে জামাই ভালো নয়, কোন খোঁজ খবর নেয় না। ভুদিও কিছু ভাবে না। এই বাজারে কে কার খোঁজ রাখে, একা বাঁচলে বাপের নাম। ভুদি নিজের নিয়েই থাকে। সকালে উঠে একটা বস্তা নিয়ে বেরিয়ে যায়। এই কয়েকটা দিন অবশ্য বস্তার সাথে একটা বালতি নিচ্ছে। রাস্তাতে গোবর পেলেই তুলে নেয়। বস্তির একজন ঘুঁটে দেয়, বালতি ভর্তি থাকলে ভুদিও কিছু টাকা পায়, তার পর বস্তাতে প্লাস্টিকের বোতল, লোহা, যা পায় তুলে এনে বিক্রি করে দিব্যি টুকটুক চলে যায় ভুদির। শুধু একটু ভোরের দিকে বেরোতে হয়। আগে বেলাতেই বেরোত, কিন্তু যবে থেকে গোবর কুড়াচ্ছে বেরোনোর সময়ও পাল্টাতে হয়েছে। একটা নতুন লোক আসছে, ও আবার সাইকেলে একটা বড় প্লাস্টিকের বালতি নিয়ে ঘুরে ঘুরে গোবর কুড়ায়।

ঘরের ভিতর ঢুকে পুচুটাকে খাটিয়ার এক কোণে শোয়ায়। ডাক্তারবাবু বুকের দুধ ভালো করে খাওয়াতে বলেছেন। শোনার পর থেকে মাথায় কথাগুলো ঘুরছে। কিন্তু কোথা থেকে খাওয়াবে। নিজের মেয়েরও একটা মেয়ে আছে, এখানে আসে না, ভুদিও কোন যোগাযোগ রাখে না। কিন্তু পুলিশ এসে যদি সব শুধায়, ঠিকানা চায় ? ভুদির শরীর খারাপ লাগে, ঘামে শরীর ভিজে যায়। একটা লম্বা শ্বাসের সাথে সব ভাবনাগুলো জড়িয়ে যায়। পুচুটাকে কুড়িয়ে এনেই ভাবতে আরম্ভ করেছিল। কুড়াতে গিয়েও অনেকবার ভেবেছিল, গাড়িটা থেকে দুটো ছায়া নেমে যখন রাস্তার পাশে পুচুটাকে রাখছিল, ভুদি কিছুই বুঝতে পারে নি। ভোর রাতের অন্ধকারে এমনি কত কিছু হয়। এক বছর আগেই রাস্তার ঝোপের ধারে একটা গাড়ি থেকে একটা বস্তা ফেলতে দেখেছিল। ওরাও ভুদিকেও দেখেছিল, কিছু বলেনি। পরে শুনল একটা লাশ ফেলে গেছিল। ভয়ে কয়েকটা দিন আলো না ফুটলে বেরোত না। কিন্তু কাউকে কিছুই বলতে পারেনি। সেদিন দিব্যি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, তারপরেও কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায়, ঝোপের কাছে যেতে দেখতে পায়। আশে পাশে দেখবার চেষ্টা করে, কাউকে দেখতে পেলেই জানাবে, কিন্তু লোক নেই। কি করবে ভাবতে পারে না। বস্তিতে নিয়ে গেলে সবাই জিজ্ঞেস করবে, কি জবাব দেবে ? ফেলে চলে আসতেও মন চাইল না। তারপরেই নিজের বোতল কুড়ানোর চটের ব্যাগটার ভিতর ভরে সোজা বস্তিতে চলে আসে। রাস্তাতে হাঁটার সময়েও ভাবে, পুলিশে দিয়ে দেবে, অথবা কাউকে বিক্রি করে দেবে। ঘরে ফিরে খাটিয়াতে শোওয়াতেই কিরকম অদ্ভুত লাগে। কাদের ছেলে কে জানে, একমাস বয়স হবে। মাথা ভর্তি চুল, গা’টাও এক্কেবারে চকচক করছে, শুধু একটু কাদা লেগে ছিল। এরকম বাচ্চাকে কেউ ফেলে দেয়? এক্কেবারে পিচাশ এরা। ভুদি গরম জল করে নিজেরই একটা ছেঁড়া ত্যানা দিয়ে গা’টা ভালো করে পরিষ্কার করে। পুচকুটা যত চেল্লাচ্ছিল তত ভুদির শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। কান্নার আওয়াজে একে একে অনেকেই ভুদির ঘরের সামনে ভিড় করতে আরম্ভ করে। বস্তিতে অনেকেই এমনি ছেলেমেয়ে নিয়ে আসে। কত বড় বড় ঘরের ছেলে মেয়ে সমাজের অজান্তে এই বস্তিতে বড় হচ্ছে। এটা বস্তির অনেকেই জানে। তাও একবার জিজ্ঞেস করে। যেমন ভুদিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে কি তুমি চুরি করে আনলে?’ ভুদির চোখ মুখ শুকিয়ে যায়। কোন রকমে আমতা আমতা করে উত্তর দেয়। সেদিন অবশ্য পাশের ঘরের সালমা পুচুকে তুলে নিয়ে সবার সামনেই দুধ খাওয়াতে আরম্ভ করে। বেরোনোর সময় বলে যায়,‘কাঁদলেই আমার কাছকে নিয়ে আসবে গো, দুধ তো তুমি দিবে না।’

আরো অন্ধকার নামলে ভুদি এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকে, চিন্তায় দুচোখের পাতাগুলো এক করতে পারে না। রাতের অন্ধকারে পুচকুটাকে সেই ঝোপের মধ্যে ফেলে এলেই ভালো হত, খাক যত পারে তত কুকুর, বিড়াল সব কামড়ে ধরুক। কিন্তু তারপর ? আবার কি একা একা থাকতে পারবে ? পুচকুটা আচমকা কেঁদে উঠতেই চমকে ওঠে। কাছে যেতেই দেখে হাতে একটা মশা কামড়েছে। ভুদি সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটাতে চুন লাগিয়ে মুখে একটা বোতল ধরে। পুচকুটা মুখে বোতল নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

বাইরে কুকুর ডাকছে। এই সময়টা রোজই কুকুরের ডাক শোনা যায়, অনেকেই কাজ থেকে বাড়ি ফেরে, কুকুর ছায়াতেও ভয় পায়। ভুদি আস্তে আস্তে ওঠে। একটা পুঁটুলিতে নিজের কয়েকটা শাড়ি গুছায়, আরেকটা পুঁটুলিতে পুচুর খাবার, দুধের বোতল, গোছায়। তারপর পুচকুর কাছে এসে দেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একটা শ্বাস ফেলে ভুদি। আচ্ছা একে বড় করা যাবে না ? অনেক বড়, স্কুলে পড়বে, ঐ বড় বাড়ির ছেলেগুলোর মত চাকরি করবে, কিন্তু ততদিন নিজে বাঁচতে পারবে ? একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের মনেই হেসে ওঠে, ‘ভুদিরে তাও যদি নিজের পেটের হত ?’ না হোক গে, তুলে বাঁচিয়েছে তো, যে বাঁচায় সেও তো মা। রাস্তার ওপারের হরি মন্দিরে কীর্তন শুনতে গেছিল ভুদি, সেখানেও তো এই কথাগুলোই বলছিল। বিয়ের পর বরটা তো তিনটের জন্ম দিয়েই ফুটে গেল। তারপর এই তিনটেকে তো বড় করেছে। একজন মরে গেল সে সব আলাদা কথা, যারা বেঁচে আছে তারাও ভুদিকে দেখে না। তাছাড়া নিজের তো এখনো শরীরে ক্ষমতা আছে, লোকের ভরসাতে খাবেই বা কেন ?

ভুদি আর ভাবতে পারে না। কাঁধে দুটো ব্যাগ চাপিয়ে কোলে পুচকুটাকে নেয়। তারপর এক পা এক পা করে দরজা বন্ধ করে বস্তি থেকে বড় রাস্তায় পা রাখে। কিন্তু যাবে কোথায় ? কিছু দূর হেঁটে গেলেই রেল স্টেশন, একটা ট্রেনে চাপতে পারলেই কোন নতুন জায়গায় যাওয়া যাবে, কেউ চিনতে পারবে না, বুঝতে পারবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এত ভোরে এখানে আর কেউ ওঠে না। বড় রাস্তার বাঁদিকে হেঁটেই একদিন পুচকুটাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল, ভুদি এবার ডানদিকে চলতে আরম্ভ করে।

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

লেখালেখি শিশুকাল থেকে। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে প্রকাশিত পাড়ার দেওয়াল পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ, এরপর স্কুল ম্যাগাজিনে। বর্তমানে প্রায় নিয়মিত কবিতা ও গল্প প্রকাশ হয়।

প্রকাশিত গল্প : আনন্দবাজার রবিবাসরীয়, তথ্যকেন্দ্র, সুখী গৃহকোণ, নবকল্লোল, দেখা, মনকলম। কবিতা : দেশ, কবিসম্মেলন, কবিতাপাক্ষিক সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। 



Wednesday 22 June 2022

সংখ্যা ৬।।২২জুন২০২২।।জিম্মেদারি ।। সোমা কুশারী

 জিম্মেদারি

সোমা কুশারী 

এ কিরণ কাহা ভৈল বা রে ?

গলির ওপার থেকে বুড়ি দাদির চিৎকার কানে যেতেই রাজুর হাত ছাড়িয়ে নেয় কিরণ, তারপর দুড়দাড় করে দৌড় লাগায়। সন্ধে বেশ অনেকক্ষণ গড়িয়ে গেছে গলির টালির চালের ঘরগুলোতে। টিমটিমে হলুদ রঙের বাল্ব জ্বলতে শুরু করেছে, টুনিচাচির ঘরে হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে। নিমকি আলিশা পিঙ্কি রাজুরা গোল হয়ে বসে কি যেন করছে, একটু পরেই ফজলুল করিম লোটন টিঙ্কাসরা আসর জমাবে। তিন পাত্তি খেলার এমন নিরাপদ জায়গা কোথায় মিলবে ? কিরণ এক ছুটে নিজের খোলির ভেতর সেঁধিয়ে যায়। দাদি ক'টা কানা বেগুন খাটিয়ায় বসে কুচোচ্ছে নীচে মেঝেতে বসে নিমকি কিরণের ছোটো বোন, এক গাদা পেঁয়াজের খোসা ছাড়াচ্ছে । কিরণ লোটা থেকে জল নিয়ে ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে কালিধরা একটা প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে...

-এ দাদি এক বুন্দ তেল না বাটে !

-নাহি রে ! হম ওহি সেতো আজ খানা বনাইবে !

-কা ? ইয়ে ডিবিয়া কা তেল তু খানে মে ডালবু ? মত মরি গেইল বা তোহার !

রাগে গসগস করতে থাকে কিরণ, আর তাতেই নিমরতিয়ার মাথায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে, দুপয়সা রোজগার করছে বলে এত ঘমন্ড! এই তো সেদিন পর্যন্ত ঝাড়ুদারনীর কাজ করে বাপ মা মরা দুই নাতনিকে মানুষ করেছে। বড় মেয়েটা রাস্তার ওপারে ইস্কুল এর সামনে ঠেলা লাগাতে শুরু করার পর থেকেই যা একটু অবস্থা ফিরেছে সংসারের। সাত সকালে উঠে চানা উনা সেদ্ধ করে আলু কেটে রেডি করে ফুচকা ভাজে মেয়েটা। তারপর নাহা ধোকে হনুমানজীর ভোগ চড়ায়। ঘরে ভাতের জোগান থাকুক না থাকুক রোজ দুটো লাড্ডু হনুমান বাবার জন্য লেড়কিটা আনবেই। বহুত ভক্তি! এখুনি যে তেল নিয়ে জ্বলে উঠল তার কারণ ও ঐ পূজাপাঠ। রোজ একটা করে দীপ জ্বালায় সাঁঝবেলায়। সেই তেল আবার তুলে রাখবে অলগ সে। যত্ত সব নোটঙ্কি !

চুলার পাশে বসে রুটি সেঁকতে সেঁকতে কিরণ টিভি দেখছিল। দাদি, খাটিয়ায় আধশোয়া নিমকির মুখটা হাঁ হয়ে আছে। এই সিরিয়ালের চমকতি দুনিয়া মেয়েটাকে পাগল করে দেয়। যখন তখন লম্বা চোটি বেঁধে বাক্সে তুলে রাখা জরিদার সালোয়ার কুর্তা পড়ে গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। কিরণের এসব ভালো লাগে না। বহুত খারাপ খারাপ ছোকড়া আছে এই বস্তিতে কে কখন হিড়কি দেয় কী ঠিক আছে ? 

নিজের পড়াই লিখাই কিরণের হয়নি, বাপটা বহুত চুল্লু খেতো পেট দরদ নিয়ে হঠাৎ মরে গেল। মা মরল তার দু সাল বাদ। ঘরে তখন বড্ড অভাব। দাদির ভরসায় খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে দিন চলতো। চার ক্লাসের পর আর ইস্কুলমুখো হওয়া হলো না কিরণের! অবশ্য, ঐ ইস্কুল - ই এখন পেট ভরাচ্ছে। চানামাখা, পেয়ারামাখা, সিজনের আমড়া মেখে, ফুচকা বেচে, আলুকাটা বিক্রি করে দিন চলে একরকম। নিমকি নাইন ক্লাসে পড়ে, লিখাই পড়াইয়ে একবার মন নেই। সারাদিন টো টো করে ঘোরে। দাদির উমর হয়েছে, গোড় দরদ নিয়ে শুয়ে বসেই থাকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগায় নিমকি !

টিভি দেখতে দেখতে নিমকি হঠাৎ কি একটা শুনে ঝোপড়ির দরজা খুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কিরণ তাওয়াটা চুলার উপর থেকে নামিয়ে বোনের পিছে পিছে ছুটল, কদিন ধরেই নিমকির চালচলন ঠিক লাগছে না। কোথায় যায় কী করে কোনো পাতা নেই !

গলির ওপারে ঝুপসি মতো গাছটার নীচে নিমকি আর কেউ একজন কথা বলছে ! কিরণ লোকটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এ তল্লাটের কেউ কী ? নাকি অন্য কোনো লোক? বোনের নাম ধরে চেঁচাতে থাকে কিরণ,

-নিমকি! এ নিমকি !

মেয়েটা যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। লোকটা স্যাত করে সরে যায়। গাছ তলাটা পেরোতেই লাম্পপোস্টের এক ঝলক আলোয় লোকটাকে চিনতে পারে কিরণ। আরে এ তো হীরালাল! বস্তির বাসিন্দা ছিলো আগে। মাঝে কী একটা গন্দা কামের চক্করে পুলিশ পাকড়ে নিয়ে গেছিল। মাসকতক হলো ফিরেছে এ তল্লাটে। লোকটার তো অনেক উমর! কম সে কম চালিশ পচাশ সাল তো হবেই। ঘরে বিবি আর দোঠো লেড়কিও ছিলো। পুলিশ পাকড়ে নিয়ে যেতেই লেড়কিদের নিয়ে বিবি কোথায় যেন চলে গেছে।

নিমকি সে রাতে দাদির কাছে আচ্ছা মতো পিটাই খেলো। এত বজ্জাত কিছুতেই স্বীকার করলো না হিরালাল এর সাথে এত কিসের গল্প ? কিরণ মনে মনে ঠিক করল কাল রাজুকে বলবে কথাটা। রাজু দোসাদ কিরণের দিল কা রাজা ! ছেলেটা এই মেথরপট্টির সব থেকে ভদ্র ছেলে। কোনো গন্দা নেশা দারু উরু কী ভাং পাত্তা কিচ্ছু খায় না। মিউনিসিপালটির ক্যাজুয়াল লেবার আছে। ডেইলি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ময়লা তোলে, আর নিমকি বলে, মুখের বাঁশরীটি নাকি কিরণকে দেখলেই জোরে জোরে ফোঁকে ! নিজের মনে হেসে ওঠে কিরণ। ঠেলাটা আরেকটু সামলে নিতে পারলে রাজুর কথায় হ্যাঁ বলবে কিরণ। তার আগে নিমকিকে দশ কেলাশ পাশ করাবে। একটা ভালো কাজে ঢোকাবে। বুড়ি দাদির মোতিয়া বিন্দ কা অপারেশন করাবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কিরণ গেছিল সদর বাজারে, ডেইলি দশ কিলো আলু লাগে আলু কাটা মাখতে। সঙ্গে ধনিয়া পাত্তি, পুদিনা, খিরা, গাজর আর পেঁয়াজ ! ফিরতে ফিরতে রোজ-ই আটটা নটা বেজে যায়। বাড়ি ঢুকেই কিরণ চান ধান করে নেয়। দাদি তখন বসে বসে কাঠের জালে আলু উবালতে থাকে। কিরণ ভাত ডাল চোখা কী কোনো সব্জী রেঁধে ফেলে। আজ, ঘরে ঢুকতেই দাদি ফিসফিস করে বলে,

-ও ভাগ গই রে কিরণুয়া !

-কোন দাদি ?

-নিমকি !

-কা বোল রহি রে তু ? কাহা যাইবু !

দাদি আঙুল তুলে কোনের দিকে রাখা বড় ট্রাঙ্কটা দেখায়। কিরণের দু চোখে যেন মুহূর্তে অন্ধকার নেমে আসে। ওই ট্রাঙ্কেই তো সব কিছু থাকে ওদের... ডালা ভাঙা ট্রাঙ্কটার সামনের মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে কিরণ... পেট কাট কাটকে দশ হাজার রুপিয়া রেখেছিল কিরণ দাদির অপারেশন করবে বলে... নিজের আর নিমকির দু'জোড়া চাঁদির পায়েল, একঠো সোনার নথনি কিচ্ছু নেই কিচ্ছু না !

সারা দিন বুড়ি আর কিরণ ঘরে চুপচাপ পড়ে রইল। আস পড়শের লোকজন নানা কথা বলতে লাগলো। সবার এক কথা লেড়কিটাকে কেউ ফুসলেছে। রাজু এলো সন্ধেবেলায়। কিরণকে বললো,

-চল থানে মে !

-পোলিশ ? না বাবা না ! দাদি তীব্র আপত্তি জানালো।

কিরণ কিন্তু সোজা রাজুর সাইকেলে উঠে চললো থানায়। তাদের মতো গরীব আনপড় লোকজনকে থানার দারোগা ইচ্ছে করে ভয় দেখায়। এক্ষেত্রেও তাই হলো। রাজু আর কিরণের বহু কাকুতি মিনতির পরেও এফ আই আর হলো না। কিরণ বার বার হীরালালের নাম নিচ্ছে দেখে একটা সিভিক পুলিশ রাজুকে আড়ালে ডেকে বললো,

-তোর বৌ নাকি ? ওকে বল আনশান না বকতে ! সিয়ানা লড়কি পেয়ারের চক্করে ভেগেছে ! শুধুমুধু ঝঞ্ঝাট পাকিয়ে লাভ কী ?

দেখতে এক মাস কেটে গেল। নিমকি ফিরলো না। পেটের দায়ে ঠেলা নিয়ে বেরোলো কিরণ। দাদি, নিমকি ওরকম পালাতেই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। আজকাল সারাদিন খাটিয়ায় শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তেজ বুখারও আসে। রাজু বলে, বুড়িকে হাসপাতালে দিতে। কিরণ রাজি হয় না। ঐ বুড়িকে ছেড়ে একা কী করে থাকবে ও ? বুড়ির জন্যে বড় ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আসে, জোর করে খাওয়ায়। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না।

সপ্তাহ খানেক আগে দোসাদ বস্তির দুটো মেয়ে হঠাৎ গায়েব হয়ে গেছে খবর পায় কিরণ। মেয়ে দুটো নিমকির সহেলি ছিল খবর দেয় পাশের বস্তির সরবতিয়া। আবার থানায় যায় কিরণ। বড় সাহেবের হাতে পায়ে ধরে, নিমকির খবর যদি পাওয়া যায়! না! কোনো খবর মেলে না! রাজু ভীষন রেগে যায়। বলে,

-বহিন বহিন করে তু পাগল হয়ে যাবি! নিজের কথা ভাব !

কিরণ কিছুতেই বোঝাতে পারে না মা বাপ হারা বোনটার কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে কিছুতেই ঘুম আসে না। কোথায় গেল মেয়েটা? কে কোন নরকে নিয়ে ফেললো ভাবতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। নিজে ছোটবেলা থেকে রাস্তায় নেমে রোজগার করেছে বলে এই ভয়ংকর দুনিয়ার ছবিটা ভালো করে চেনে ! রাজু বুঝতে চায় না। বার বার একই কথা বলে,

-চল সাদি করে নিই।

দাদির শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। নিজে উঠে বসতেও কষ্ট হয়। ঘরেই পিসাপ টাট্টি করে ফেলে। কিরণ ঘরে বাইরে খাটতে থাকে। রাজু ওকে বোঝায়,

দাদিকে হাসপাতালে ভর্তি কর। ও আর বাঁচবে না ! 

কিরণ রাজি হয় না। রাজু রেগে যায়। ঝগড়া বেঁধে যায় দুজনের।

-ও বুড়িহাকে নিয়ে কব তক ভুগবি ?

-জিন্দেগি ভর ! তো সে মতলব ?

-দেখ কিরণ ! ইসি মাহিনা সাদি হোবে তো বোল… নেহি তো...

-নেহি তো ? হম না করেম সাদি...

রাজু সত্যিই চলে যায়। একা হাতে দাদির সেবা যত্ন করতে করতে কোথা দিয়ে সময় চলে যায় টের পায়না কিরণ! যখন টের পায় তখন সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। এক প্রবল শীতের রাতে তেজ বুখার আর খাসিতে কষ্ট পেতে পেতে চলে যায় বুড়ি। বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে কিরণ। প্রতিবেশীদের সাহায্যে বুড়ির শেষ কাজটুকু সারা হয়। একদম একা হয়ে যায় কিরণ। পাশের ঝুপড়ির সুশীলা খবর দিয়ে যায়, গত হপ্তায় সাদি করেছে রাজু। বহু বড়ি সুন্দর ! কোনো জবাব দেয় না কিরণ। হনুমান বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জলের ফোঁটা গড়াতে থাকে শুধু।

দিন যায় মাস যায়। প্রতি হপ্তায় থানায় হত্তে দেয় মেয়েটা। নিমকির খবর চাই যে ! নিমকি ছাড়া আর কে আছে কিরণের ? দাদি মরেছে, নিমকিও যদি না ফেরে কী নিয়ে বাঁচবে কিরণ? ও যে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল, নিমকি লিখাই পড়াই করবে দশ কেলাশ পাশ দেবে নোকরি করবে !

কিরণের ঠেলা নিয়ম মতো রোজ স্টেশনের পাশে শ্রীলক্ষ্মীদেবী গার্লস স্কুলের বিরাট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। রঙিন ছাতার তলায় টিনের কৌটোয় নানান মশলার মিশেলে হাতা দিয়ে আলু মাখে কিরণ। ফুচকায় আলুমাখা ঠুসে ভরে দেয়, ধনে পাতা ছড়ায়... তেঁতুল জল ঢালে, স্কুলের মেয়েগুলো পাতা চেটে খায়। বকবক করে কিরণের সাথে, কিরণ ওদের যত্ন করে আলুকাটা চুরমুর মেখে দেয় তারপর সুযোগ পেলেই গম্ভীর গলায় বলে...

-পেয়ার বেয়ারকে চক্কর মে মাত পড় না সমঝি ! কভি ঘর সে ভাগ মাত জানা ! লিখাই পড়াই করো ! সির্ফ লিখাই পড়াই ! 

মেয়েগুলো খিলখিল করে হাসে। একটু দূরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে...

-ফুচকাওয়ালিটার মাথাটা গেছে ! এক্কেবারে গেছে !


সোমা কুশারী

পেশায় শিক্ষিকা, বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। লেখালিখি ভালোবেসে। চারপাশের সাধারণ ঘটনা আর অতি সাধারণ মানুষের জীবনের রোদ-বৃষ্টি নিয়ে সাহিত্যের হাটে পসরা সাজান। নিয়মিত বিভিন্ন অনলাইন ও মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর গল্প প্রকাশ পেয়ে থাকে।


Wednesday 15 June 2022

সংখ্যা ৫।। ১৫জুন২০২২।।ফেরা।।অভিষেক ঘোষ

 ফেরা 

অভিষেক ঘোষ 

বন্ধুদের সাথে একটা মেঘলা দিনে, বাস থেকে নেমে, একটা বিরাট বাগানে গিয়ে ঢুকেছিল রূপ । তার নাবালক দুই চোখে, মনে হয়েছিল ঈশ্বরের বাগান । ক্লাস ফোরের বাচ্চাদের স্কুল থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে গিয়েছিল । বাচ্চাদের চোখে ছিল খুশির ঝিলিক । তারপর একটা প্রাচীন আর বিরাট গাছের সামনে বাচ্চাদের গিয়ে দাঁড়াতে বললেন ম্যাডাম । কত শিকড়-বাকড়, প্রকাণ্ড কান্ড, ডাল-পালা, অজস্র পাতা আর তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে আরেক মহাপ্রাচীন নক্ষত্রের পাঠানো সোনার কুচির ঝিলমিল ! দুনিয়াটা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এমন দিনেই বদলে যায়। আর সেদিনই রূপের দুনিয়াটাও বদলে গেল । আমরা বলি না শক্তি অবিনশ্বর... তার ধ্বংস বা সমাপ্তি নেই, শুধু তার রূপের পরিবর্তন হয় ! জীবনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই । শরীরের মৃত্যু মানেই কি একটা গোটা জীবনের শেষ ? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জীবন কি সঞ্চারিত হয় না ? যেখানে এর ব্যতিক্রম আছে, সেখানে অবশ্য বিষয়টা দুর্ভাগ্যজনক । তবে সেটা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম । শুনতে খুব অদ্ভুত লাগছে, তাই না ! আমাদের চারপাশে কিন্তু অদ্ভুত বিস্ময়ের অভাব নেই । মুখের চামড়া কুঁচকে যাওয়া, স্মৃতিহারা বৃদ্ধ মুখ, সদ্যোজাত শিশুর কচি আঙুলগুলির মায়ের আঙ্গুলের দিকে এগিয়ে যাওয়া; আবার অন্যদিকে ওই প্রাচীন গাছ, অনন্ত আকাশ, অনাদি সূর্য, মাটির সুদূর গভীরে সঞ্চিত পৃথিবীর প্রাণরস ভৌমজল, নরম ঘাসের উপর দিয়ে শিশিরস্নাত সকালের শান্ত প্রভাতী পদক্ষেপ, কিংবা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি - শিশুর চোখে এ সবই তো দারুণ বিস্ময়ের উপাদান ! সেদিন ঈশ্বরের বাগান থেকে বেরিয়ে, বাসে উঠতে উঠতেই রূপ অনুভব করল, প্রাচীন অস্তিত্বের বিস্ময় কেমন চমৎকার আনন্দের উৎস হতে পারে, কত নিবিড় হতে পারে তার অনুভূতি ! তারপর চলন্ত বাস থামল নির্জন একটা রাস্তার ধারে । ড্রাইভারের দেখাদেখি আরো অনেকে গেল টয়লেট সারতে । দিদিমণিকে লুকিয়ে রূপ নামল নীচে, বাসের পেছন দিকের অন্ধকারে গেল কৌতূহলে । তখন সন্ধ্যা নেমেছে, দিগন্তে ক্ষীণ লালের ছোঁয়ায় রাতের কালো ছোপ পড়তে শুরু করেছে । হঠাৎ রূপের পিছন থেকে একটা নেশাধরা গন্ধ রুমালের মতো, বেঁধে দিল তার নাক-মুখ । চোখদুটো ঘুমে বুজে এল । কতটা সময় কেটে গিয়েছিল, বুঝতে পারেনি রূপ । জ্ঞান ফিরলে রূপ বুঝল, অচেনা জায়গা । একটা অত্যন্ত পুরনো বাড়ি, কিন্তু এই ধরণের বাড়িতে আগে কখনও আসেনি সে । অনেকদিনের জমা ধুলোয় ভরা আসবাব । আর সম্পূর্ণ উধাও সেই নেশাধরা গন্ধটা, তার জায়গায় অন্য অন্য সব গন্ধ, কিছু চেনা আবার কিছু অচেনা । কিন্তু চোখের সামনে তখন সমস্ত অন্ধকার ! 

কিন্তু আশ্চর্য ! এখানে কোথাও কোন শব্দ নেই ! যেন কেউ রিমোটের 'মিউট' স্যুইচটা অন করে দিয়েছে, আর তারপর রিমোট-টা হারিয়ে গেছে । সেদিন থেকে দেখলে, রূপ তার জীবনটাকে অন্য এক পৃথিবীতে আবিষ্কার করল, এখানে শব্দ হয় না, রূপ-কে শব্দ তৈরি করতে হয় । মেঝেতে পা ঘষে, জলের জাগ-টা জোরে মেঝেতে রেখে, গান গেয়ে, চিৎকার করে, নিজের ছায়ার সঙ্গে বকবক করে, রূপ শব্দ তৈরি করে । এ এক অন্য অভিজ্ঞতা । ওইটুকু বয়সে একা একা, একটা বাড়িতে ভয় আর অজানার সঙ্গে লড়াই করে, নিঃসঙ্গ ধূসরতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে রূপ বুঝতে পারে, সে বদলে যাচ্ছে । এখানে মা নেই বাবা নেই, স্কুলের কোনো তাড়া নেই, বাগানে নিজের হাতে পোঁতা গাছগুলোয় জল দেওয়া নেই, দুপুরে প্রতি রবিবার উঠোনের গা-ঘেঁষা বারান্দায় ঠাকুমার সাথে শুয়ে, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনা নেই । এখানে রাত্রে মা পাশে শোয় না, বাবা স্বার্থপর দৈত্য, সুখী রাজপুত্র বা সেই ব্যাঙ্ রাজপুত্রের গল্প শোনায় না । স্কুলের পড়া করতে হয় না, অংক কষতে হয় না, টিভি নেই, মোবাইলে গান হয় না, ঘরের সেই লম্বা টিউবটা নেই, পড়ার টেবিল নেই, সেই চেনা দেওয়াল -ছাদ -জানলা -দরজাগুলো নেই । সর্বোপরি জীবনে কোনো নিয়ম নেই । সব সময় একটা গুমোট ভাব, সিলিং ফ্যান বা টেবিল ফ্যান কিছুই নেই, একটা স্যাঁৎস্যাতে গন্ধ চারিদিকে ! জানলা, দরজাগুলো সব সময় বন্ধ । বছরে একবার বোধহয় ঘরগুলো পরিষ্কার হয়, এত ময়লা ! পুরু ধুলো জমে আছে । চিৎকার করে ডেকে, কেঁদে, দরজা-জানালায় জোরে ধাক্কা দিয়ে কোন লাভ হয়নি । পুরনো মোটা কাঠের ভারী জিনিস সব । খাটে ছারপোকা, মেঝেতে আরশোলা আর ইঁদুর, রাত্রে অল্প মশা; আর তাদের জন্যই প্রথম প্রথম দুই একবার চমকে ওঠার মতো শব্দ শুনতে হয়েছে রূপ-কে । তারপর যত দিন গেল, ওই শব্দগুলো এখানকার নির্জনতার সঙ্গে এমন মিশে গেল যে, ওগুলোকে আর আলাদা করে এখন শোনা যায় না । দরজার পাশের খোপ দিয়ে ভিতরে একটা থালায় হয় রুটি, নয় ভাত আর একটা বড় বাটিতে জাবনা ঠেলে দেওয়া হয় তার জন্য । কে দেয়, তার গলা কেমন বোঝা যায় না । তার পায়ের শব্দ বা, অন্ততপক্ষে কখনও হাঁচি - কাসির আওয়াজটুকুও কখনও শোনা যায় না । খাবার দেওয়ার সময়টাও নির্দিষ্ট থাকে না । তবুও যে রূপ এই অন্ধকারে ডুবে যায়নি, তার কারণ প্রতি মাসে একবার করে দাদু আসে । অনেক দাড়িওয়ালা একজন বুড়ো লোক। কেক, জলের বোতল, বিস্কুট, মাখন, সন্দেশ এইসব এনে একটা আলমারিতে তিনি তুলে রেখে যান । রূপ গুনেছে দাদু আটাশ বা তিরিশ দিন বাদে বাদে আসেন... বুড়োটাকে রূপ ভালোই বাসে। তিনি মোটের উপর কথাও বলেন । মাথার উপরে ছাদে বসানো কাঁচটাই দিনের হদিশ দেয়... তা থেকেই রূপ হিসেব করে নিতে পারে ক’টা দিন গেল । 

এমনিতে রূপ যেখানে বেলা সাতটা-র আগে ঘুম থেকেই ওঠে না, সেখানে এই বাড়িতে ওই এক ফালি কাঁচের ফাঁক দিয়ে আসা আলো দেখবার জন্য, অনেক আগে থেকেই সে উঠে বসে থাকে । অবশ্য এখানে তো কোনো কাজ নেই তার, তাই রাত্রে খুব তাড়াতাড়ি শুয়েও পড়তে হয় । এখানে একটা বড় ঘর আর লাগোয়া বাথরুম আছে । ক্রমশ এই জীবনটাই রূপের ভালো লাগতে শুরু করেছে । এই বড়োসড়ো ঘরটায় অনেক খুঁজেছে রূপ... কিছুই নেই । রূপ এসেই দেখেছিল, যে সমস্ত দেওয়ালে দুপুরের আলো ভালোভাবে এসে পড়ে, সেই সব দেওয়ালেই ছবি আঁকা । কাঠ কয়লা, এমনকি জলে ভেজা ময়লা ধুলোও আঙুল দিয়ে টেনে টেনে, দেয়ালে ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে, এমনটাই বুঝেছিল ছোট্ট রূপ । এখন রূপও সেই অভ্যেসে অভ্যস্ত । ভোর থেকে অনেকক্ষণ স্কাইলাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ক্লান্ত হয়ে, সে ম্লান আলোয় বদলে যাওয়া আসবাব ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ছায়াগুলো লক্ষ্য করতে থাকে । তারপর খিদে ভুলতে ছবি আঁকতে থাকে । দিনে দু'বার দরজার পাশের খোপে তার জন্য খাবার আসে । আর ঘরের একমাত্র আলমারিতে রাখা দাদুর আনা খাবারগুলো আগে দ্রুত শেষ হয়ে যেত, এখন রূপ সেগুলো সঞ্চয় করে রাখতে শিখেছে । নিত্য  অভাব মানুষকে অসংযমী করে তোলে, কিন্তু অনিয়মিত অভাব মানুষকে সঞ্চয়ী করে । রূপ কিন্তু খুব নিস্তেজ বোধ করে আজকাল । তার বারবার মায়ের মুখটা মনে পড়ে । চোখ বুজে মায়ের গলাটা মনে করার চেষ্টা করে সে । এখানে তার দুবার জ্বর এসেছিল প্রথম দিকে, কেউ জানতেও পারেনি । আবার নিজে নিজেই কখন সেরে গেছে । রূপ এখন অন্ধকারেও খুব ভালো দেখতে পারে । ঘরের একমাত্র চওড়া কাঠের কারুকাজ করা টেবিলটার নীচে ঢুকে রূপ একটা সমুদ্রের ছবি আঁকে । কত চেষ্টা করেও সে ছবিতে দেখা সমুদ্রের মতো জ্যান্ত ঢেউ কোনোদিন আঁকতে পারেনি । সব রঙ্-ই বা এই বদ্ধ ঘরে কোথায় পাবে সে ? বাবা রূপকে অল্প অল্প আঁকা শিখিয়েছিল । কিন্তু এতো কঠিন আঁকা ? রূপ কখনো সমুদ্রে বেড়াতে যায়নি । ওর খুব ইচ্ছে করে, ঢেউগুলো দেখে এসে ছবি আঁকতে । কিন্তু এখানে সমুদ্র কোথায় ? সে কীভাবে যাবে ? সে যে বন্দী ! জীবন যদি নদী হয়, তাও সমুদ্র বহুদূর ! আর জীবন জেলখানা হলে, সমুদ্র অচিনপুর । 

একটা কথা আছে না, একেকটা দিন অন্য রকম ! এই গল্প যেদিনকার, সেদিনটাও ছিল তেমনি অন্যরকম । রাতে যাদের উৎপাতের শেষ নেই, সেই দুই ক্ষুদ্র প্রাণিকে সকাল থেকে তাড়া করে করে, কোণঠাসা করে অবশেষে নিকেশ করল রূপ । তার সঞ্চিত খাবারের আলমারিটা ও কিছুটা সুরক্ষিত হলো এইভাবে । ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীরে সে যখন বড় টেবিলটার ঠিক উপরের স্কাইলাইট-টার দিকে তাকালো, অবাক হয়ে দেখলো কাচটার উপর জমে থাকা ময়লাগুলো, বড়ো বড়ো জলের ফোঁটায় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে । বৃষ্টি হচ্ছে তাহলে ! এখানে আটকে যাওয়ার পর থেকে রূপ এই প্রথমবার বৃষ্টি দেখলো । প্রথমে ময়লাগুলোর জন্য কাচটা কাদা-কাদা হয়ে গেল । তারপর ফোঁটায় ফোঁটায় ময়লা ধুয়ে যেতে লাগলো । এবারে কাচের সঙ্গে কাঠের ফাঁকটা দিয়ে গড়িয়ে নামতে লাগল ময়লা জল । পরে দেখা গেল টেবিলটা জলে জল হয়ে গেছে । কোণ বেয়ে সেই জল মেঝেতে গড়ালো । বিকেল নাগাদ বৃষ্টি থামল । আর ঠিক তখনই ঘরের বাইরে যাওয়ার দরজাটায়, তালা খোলার শব্দ হলো । তারপর পাল্লাটা অল্প ফাঁক হলো আর পাল্লাদুটোর ফাঁক দিয়ে টর্চের আলো আর পুরনো একজোড়া কেডস দেখা গেল । দাদু ঢুকেই কী বলবেন, রূপ জানে । ঠিক তাই হলো । দাদু কাঁপা গলায় বললেন, "হয় তুমি বেঁচে থাকবার চেষ্টা করবে, নয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে । খুশি হলাম এটা দেখে যে, তুমি প্রথম চেষ্টাটাই করছো।" রূপ জানে দাদুও একদিন তার মতন এই ঘরেই বন্দী ছিলেন । দাদু রূপ-কে গল্প করেছেন, প্রথম প্রথম তিনি এই দেওয়ালগুলোকে, দরজা-জানালাগুলোকে ঘেন্না করতেন । তারপরে এগুলোতেই তাঁর অভ্যাস হয়ে গেল । আরও পরে দাদু এই ঘরের দেয়াল, মেঝে, ছাদের ওই আলো আসার অবকাশটুকু, - সবকিছুর উপরেই নির্ভর করতে শুরু করেন । ঠিক এই অবস্থায় রূপ নিজে এখন রয়েছে । তাইতো সে এত এত ছবি আঁকে । আঁকা ছবির উপর আবার অন্য ছবি আঁকে । এমনকি রূপ ওর মাকে একটা দেওয়াল-চিঠিও লিখেছে । একটা পুরনো বাঁধানো ছবির আড়ালে সেটা লুকানো রয়েছে দেওয়ালের গায়ে । দাদু বলেছিলেন তারপর তিনি একদিন মুক্তি পান । কিন্তু বাইরে গিয়ে তাঁর চোখে আলো সহ্য হচ্ছিল না । মনে হচ্ছিল গাড়িগুলো ভীষণ জোরে ছুটছে । লোকজন বড্ড জোরে আর তাড়াতাড়ি কথা বলছে । বাইরে বড্ড আওয়াজ চারিদিকে । কেমন ভয় ধরে যায় দাদুর মনে । তাঁর মনে হয়েছিল পৃথিবীটা যেন বড্ড জোরে ঘুরছে । সেই থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন । রূপ-কে তিনি কেন আটকে রেখেছেন, তিনি বলেননি । তিনি তো চাইলেই মুক্তি দিতে পারেন তাকে ! কিছুই বলতে চান না তিনি । চুপ করে থাকেন, গম্ভীর হয়ে যান । তারপর কখনো ধমকে ওঠেন, - "থামো তো বাপু, এতো প্রশ্ন কোরো না, এত শব্দ কোরো না ।" সত্যি অতগুলো দিন মানুষের কথা না শোনার পর, এত কথা শুনে যাওয়া, সহ্য করা শক্ত কাজ । হার মানতেই হয় রূপ-কে। দাদুই রূপ-কে এই ঘরেতে বন্দী করেছেন, এতদিনে সে এটা জেনে গেছে । তিনি এটা কেন করেছিলেন, সেটা বোধহয় প্রয়োজনীয় নয় । কিন্তু তিনি যে এটা করেছিলেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । 

কিন্তু এবার গোড়া থেকেই দাদুকে দুর্বল মনে হল । মরা ইঁদুরদুটোকে লেজ ধরে বাইরে ফেলে দিয়ে এলেন তিনি । রূপ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো, "মরে গেলে তারপর আমাদের কী হয় ?" দাদু একটু ভেবে জবাব দিলেন, "আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানেই আবার ফিরে যাই ।" রূপ জানতে চায়, কিন্তু প্রশ্ন খুঁজে পায় না । তাই আপন মনেই বলে, "কিন্তু আমার তো মনে নেই, আমি কোথা থেকে এসেছিলাম ?" এবার দাদু ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন, "ওইখানেই তো মুশকিল । আমরা মনে করতে পারি না বলেই, ফিরতেও পারি না । অথবা হয়তো ফিরতে চাই না!" এরপর তিনি পা থেকে কেডস্ খুলে ফেলেন । রূপ দেখে, দাদুর জুতোর তলা ফেটে গিয়েছে । পায়ের তলায় ফোসকা পড়ে লাল হয়ে আছে । একটা পা থেকে তো অল্প রক্তও বেরিয়েছে, দেখে মনে হয় রূপের । তারপর দাদু জাগ থেকে জল খেতে খেতে বলেন, "আমি আর লড়তে পারছি না... হার মেনে নিয়েছি । এবার শুধু মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা । তবে তার আগে তোমায় একটা উপহার দেবো ।" একথা শুনে রূপ-এর চোখে জল আসে । দাদুর কপালে হাত দিয়ে দেখে, খুব জ্বর এসেছে ওঁর । রূপ তাঁর কপালে হাত দিলেই একটা বহু পুরনো ক্ষত অনুভব করে, কপালে হাত না রাখলে যার অ্তিত্ব বোঝা যায় না । দাদু টর্চ জ্বেলে চারিদিকে তাকিয়ে মন্তব্য করেন, "ইস্ ! বড্ড ঝুল আর ময়লা জমেছে দেখছি । একটু পরিষ্কার করতে পারো না ঘরটা ? নিজের থাকার জায়গা নিজেকেই পরিষ্কার রাখতে হয় ।" রূপ অবশ্য মাঝে মাঝে ঘরটা পরিষ্কার করে - নাহলে তো থাকাই যেত না । বাড়িতে তাকে দিয়ে একটা কাজও কেউ করাতে পারতো না । আর এখন দেখো দেখি - এ এক নতুন রূপ । 


একটু পরে খোপ দিয়ে দুটো থালা আসে ভিতরে । দাদু তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েন । রূপ বাড়িতে মা-কে দেখে জলপট্টি দিতে শিখেছিল । আগেও সেটা কাজে লেগেছে । এদিনও সে নিজেই দাদুর কপালে বার সাতেক জলপট্টি লাগালো । ওই কপালে হাত দিয়ে তার নিজের ঠাকুমাকে মনে পড়ছিল, চোখে জল এসে যায় রূপের । এরপর সে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে ! ভোরের ঠিক আগে দাদু ঘুমন্ত রূপকে ডেকে তুললেন । ধড়মড় করে উঠেই রূপ স্কাইলাইটের দিকে তাকালো । নাহ্ এখনও দিনের আলো সেভাবে ফোটেনি । দাদু দরজাটা পুরো খুলে দিলেন, এতটুকু শব্দ না করে । বোঝা গেল, ওরা কেউ তালা দেয় নি । রূপ-কে নিয়ে দাদু বাইরে বেরিয়ে এলেন । বাইরে পা দিয়েই বিহ্বল রূপ সভয়ে পিছিয়ে গেল । কিন্তু কীসের ভয় ? এ তো আমাদের আজন্ম-পরিচিত পৃথিবী । কিন্তু এখন ওই ঘরটার চেয়েও কি তা বেশি চেনা, রূপের কাছে ? ওই ঘরটার আশ্রয়টুকুই যে এখন রূপের পৃথিবী । 

তারপর লম্বা একটা করিডোর পেরিয়ে, নোংরা ঝোপ-ঝাড় ভ'রা উঠোন পেরিয়ে, ওরা দু-জন বাইরের চৌহদ্দিতে এসে দাঁড়ায় । ঝোড়ো হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোমেলো করে দেয় রূপের চুলগুলো । আর ঠিক তখনই সেই দামাল হাওয়ায় একটা অচেনা গাছের ডাল, সজোরে এসে চপাট করে আঘাত করে তার ছোট্ট কপালে । আচমকা আঘাতে সে ককিয়ে ওঠে, দাদু কিন্তু নির্বিকার । সে টেরও পায় না, দাদুর কপালের মতোই ওই একই জায়গায় তার কপালেও চিরতরে একটা ক্ষতচিহ্ন আঁকা হয়ে গেল । রক্ত ঝরে জায়গাটা থেকে । সে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে, এখনও রাতের অন্ধকার কিছুটা গায়ে মেখে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা, আর সামনে ভবিষ্যৎ । ঝিঁঝির ডাক যেন কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়... এমনটাই মনে হয় রূপের । দাদু ওর হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন, "আজ তোমায় সমুদ্র দেখাবো । তোমার উপহার । তারপর তুমিই ঠিক করবে, তুমি কোথায় ঢেউয়ের ছবি আঁকবে - অন্ধকার ওই ঘরে নাকি বাইরের পৃথিবীর এই আলোতে ? একদিন আমারও এই সুযোগ এসেছিল... আমি বেছে নিতে পারিনি । আজ তোমার পরীক্ষা । 

ধীরে ধীরে সৈকতে আলোর ছোঁয়া লাগে... দূরে কয়েকটা ডিঙি নৌকায় ঢেউয়ের ধাক্কা ও তাদের টলোমলোভাব চোখে পড়ে রূপের । অসুস্থ শরীরটা টেনে টেনে এগিয়ে চলেন দাদু । সামনে কিছু দূরে যেটা দেখা যাচ্ছে আর অমন গর্জন শোনা যাচ্ছে, ওটাই কি তবে সমুদ্র ? ওইগুলোই তবে ঢেউ ? ফসফরাসের সাদা আলো ম্লান করে, ঢেউয়ের মাথায় ছড়িয়ে যাচ্ছে কমলা-লাল রঙের স্রোত । ঝাউয়ের বন হাওয়ায় শনশন্ শব্দ তুলছে আর দুলছে… বুঝদারের মতো মাথা নাড়ছে বাতাসে । বালি উড়ছে মৃদু । দাদু নামতে নামতে হঠাৎ ধপ্ করে বালির উপর বসে পড়েন । রূপ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, চিৎকার করে ডাকে । সাড়া না দিয়ে, তিনি ওখানেই শুয়ে পড়েন চরম ক্লান্তিতে । কেডস্ না পরেই চলে এসেছেন, গোড়ালি অব্দি তাঁর বালি চিকচিক্ করছে । দাদু অস্ফূটে কেবল বলেন, “যাও… ।” রূপেরও খালি পা, খালি গা । কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর, রূপের শরীর থেকে যেন অগোচরেই একটা শিকল খসে পড়ে । বালির উপর কচি কচি পায়ের ছাপ ফেলে রূপ ছুটে চলে যায় জলের নাগালে, সাদা ফেনায় সে পা ডোবায় । ঢেউগুলো তখন তার দিকে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছে ।

অভিষেক ঘোষ 

পেশায় শিক্ষক, নেশায় কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক । প্রকাশিত কবিতা সংকলন 'শব্দের অভিযান' ও উপন্যাস 'পরজীবী' ।






Wednesday 8 June 2022

সংখ্যা ৪।।৮জুন২০২২।।পারমিতা, দীপেশ সুব্বা ও সেই চোখ ।। বিজয়া দেব

 পারমিতা, দীপেশ সুব্বা ও সেই চোখ

বিজয়া দেব 

দীপেশ সুব্বা নমস্কার করল। আকাশরঙা জিনস, সাদা পাঞ্জাবী, মুখে অনাবিল হাসি। এখনও হাসিতে সারল্য বেঁচে আছে, দীপেশকে দেখে মনে হল। 

 সমতল ও পাহাড়ের মানুষের মাঝে পার্থক্য আছে। সমতলের মানুষের মাঝে বড্ড জটিলতা। জীবনের আঁকিবুকি রেখায় জর্জরিত জীবনযাপন। এখানে তেমন নয়।

   নারীধর্ষণেও সমতল এগিয়ে। পাহাড়ি মেয়েরা অনেকটাই স্বাধীন, খুব পরিশ্রমীও। এরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল নয়। অথচ সভ্য সমাজের মানুষ বা তথাকথিত সুশীল সমাজের মানুষ এদের জীবনযাপনের উপর তেমন আলোকসম্পাতও করে না।

    রেস্তরাঁর ভেতরে পাহাড়ি মানুষেরাই খাবার তৈরি করছে। রেস্তরাঁর পেছনে দীপেশ সুব্বার বাড়ি। টিনের চাল, পাকা ঘর, সামনে প্রশস্ত বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ার, একজন পাকাচুলো বুড়ো লোক বসে আছে। পারমিতাকে উঁকি মেরে তাকাতে দেখে দীপেশ হেসে বলে - মেরে দাদাজি। ধূপ মে ব্যয়ঠা হুয়া। - কথাটা শেষ হতে না হতেই ছবিতে দেখা পাহাড়ি রমণীর মতই পাহাড়ি ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এল এক প্রৌঢ়া। 

দীপেশ বলে - ইয়ে হ্যায় মেরে দাদি। এখন পাহাড়ে যাবে। ওখানে পাহাড়ি ফুল মিলবে। সাদা অর্কিড, ঝুড়িতে তুলে আনবে, বিকেলে বাজারে বিক্রি করবে। জল ছিটিয়ে দিয়ে তাজা রাখবে, বিকেলে ফুলের বাজারে বিক্রি হবে। 

  - আউর দাদাজি নেহি যাঁতে ?

  - নেহি জী। হমারা আওরতলোগ ইয়ে কাম করনা পসন্দ করতে হ্যায়। And our society is matriarchal।

বাহ্ দীপেশ সুব্বা তো ভালো ইংরেজী জানে। 

-কোন পাহাড়ে যাবে ? 

-জী ডাওহিল। 

পারমিতা চমকিত হয়ে বলে - ডাওহিল ? 

-জী। ইয়ে দেখিয়ে ডাওহিল যানে কা রাস্তা। লেকিন ইতনা দূর যানে কা জরুরত নেহি, দাদিজি আসপাস সে কালেক্ট করেঙ্গে ফুল, স্পেশালি হোয়াইট অর্কিড। 

ডাওহিল। অনেক রোমাঞ্চক গল্প আছে ডাওহিলকে ঘিরে। একদিন কী সে দাদির সঙ্গে যেতে পারে ? মাথায় পাহাড়ি ঝুড়ি নিয়ে, সংগ্রহ করবে সাদা অর্কিড, তারপর ফুলবাজারে গিয়ে তা বিক্রি করবে। 

আগে থাকার বন্দোবস্ত হোক। তারপর ব্যাপারটি নিয়ে ভাবা যাবে। 

   কার্শিয়াং এর একটি রেস্তরাঁয় বসে রেস্তরাঁর মালিক দীপেশ সুব্বার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পারমিতা ভাবছিল দীপেশের দাদি এই বয়েসে পাহাড়ে গিয়ে ঝুড়িভর্তি ফুল নিয়ে আসবে বিকেলে বাজারে বিক্রি করবে - এই চমৎকার প্রাকৃতিক আবহে একটা মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপনে কী জানি কতখানি মুক্তি ও আনন্দ আছে ! একবার তো তার স্বাদ নিতেই হয়। 

  পাহাড়িদের অনেকটাই সরল স্বচ্ছ যাপন। অথচ সমতলের জীবনে পদে পদে অস্বস্তি, বক্রতায় জটিল, অদ্ভুত অস্বচ্ছ যাপন, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পারমিতার। কেন ? মানসিক পরিমন্ডল কি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে নাকি ? 

দীপেশ হেসে বলে - আপ কিধর ঠ্যয়রে হো ? 

-এখনও কোথাও যাই নি। খিদে পেল তাই গাড়ি থামিয়ে এখানে খেতে এলাম। তবে দু'চারটা হোটেলের নাম এনেছি। 

দীপেশ উৎসাহিত হয়ে বলে - আমার হোটেল ভি আছে। বহোত আচ্ছা। আপকো পসন্দ হোগা। 

পারমিতা হেসে বলে - বেশ। 

    পারমিতা একা এসেছে কার্শিয়াং। মনটা বিকল হয়েছিল। সারাদিন আই টি অফিসের কাজ, প্রমোশন নিয়ে টানাপোড়েন, সহকর্মী যাকে ভালবাসত সম্প্রতি তার সাথে সম্পর্কচ্যুত হয়ে যাওয়া... অতি-উত্তর আধুনিকতার আবহে যার চালু নাম - ব্রেক আপ। তার দেহ চায় শৌভিক। তার আর তর সইছে না। সেদিন কথা বলতে বলতে এত জোরে তাকে চেপে ধরেছিল যে তার মনে হচ্ছিল স্থান কাল পাত্র বিশেষে এই শৌভিক একজন ধর্ষক হতে পারে। সে এতে রাজি না হওয়ায় চটে লাল। বলেই দিল - তার নাকি শারীরিক সমস্যা আছে, ডাক্তার দেখানো দরকার। 

আচ্ছা এই সময়ে কেন এমন হচ্ছে ? শারীরিক মিলনের ইচ্ছে হয়ত তারও হত। তারজন্যে তো কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। ভালবাসা নামে শব্দটা হঠাৎ করে এমন  " নেই " হয়ে গেল ? পণ্যায়িত আবহে সত্যিই ভালবাসা টিঁকতে পারে না, উভয়ের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা আছে। 

  এই সময় ও সমাজে টিঁকে থাকতে হলে একক অস্তিত্বে বিশ্বাসী হতে হবে, এছাড়া আর কোনও বিকল্প আদৌ নেই। 

 পারমিতা ভাবছিল সে ইচ্ছে করলে পাহাড়ি মেয়েদের নিয়ে গবেষণা করতে পারে। ওদের জীবনযাপনের মধ্যে একটা খোলা হাওয়া আছে। পাহাড়ি মেয়েদের পাহাড়ি ছেলেরা ধর্ষণ করেছে বলে শোনা যায়নি। ওটা হতে পারে সমতলের মানুষের দ্বারা। পিতৃতন্ত্রের শিরাউপশিরা ছড়িয়ে পড়েছে যে দেহ কাঠামোতে। 

  দীপেশ সুব্বার হোটেলটি বেশ পছন্দ হল। ততটা বড় নয়, তবে পাহাড়ের কোলে, ভারি মনোরম। দীপেশ বিকেলে দেখা করতে এল। জানতে এল- সব ঠিক আছে তো ? পছন্দ হয়েছে তো হোটেলের ঘর, খাওয়াদাওয়া ? 

পারমিতা বলে - সব ঠিক আছে, তবে আমি আপনার দাদির সঙ্গে ডাওহিল যাওয়ার পথে হেঁটে যেতে চাই। সেই ঝুড়ি মাথায় ঝুলিয়ে, পাহাড় থেকে সংগ্রহ করব ফুল, ঝুড়ি ভর্তি করব তারপর ফুলের বাজারে গিয়ে সাদা অর্কিড বিক্রি করব।

দীপেশ হেসে বলে - অ্যাডভেঞ্চার ? 

পারমিতা - উহুঁ তা নয়,অনলি টু কালেক্ট এক্সপেরিয়েন্স। 

দীপেশ - দাদিজি পয়দল যাতা হ্যায়, ইটস নট পসিবল ফর ইউ। 

পারমিতা - দাদিজি পারলে আমি পারব না ? 

দীপেশ - আমরা তো পাহাড়ে থাকি, দাদি যেটা পারবে আপনি পারবেন না। আপনাদের সুখে থেকে অভ্যাস... ডোন্ট মাইন্ড, ইয়ে ফ্যাক্ট হ্যায়। 

ঠিক আছে আমি আপনাকে নিয়ে যাব, গাড়িতে যাবেন। 

পারমিতা - কিন্তু আমি দাদিজির মত মাথায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে যেতে চাই। 

দীপেশ হা হা করে হেসে উঠল। বলল - বেশ ঝুড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। ওখানে গিয়ে মাথায় ঝুলিয়ে অর্কিড তুলবেন। ঠিক আছে, আগামীকাল যখন দাদি বেরোবে তখন আমি আসব গাড়ি নিয়ে, কাল দাদিজি ভি গাড়িতে যাবে। আপনাকে সোজা ডাওহিল নিয়ে যাব। ওটা দেখুন আগে, তারপর আপনার ফুল বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেব। তবে ডাওহিল সম্পর্কে সব খবর জানা আছে ? ওখানকার অশরীরীর সম্পর্কে ? ওরা দিনদুপুরেও ঘাড় মটকাতে আসে। ভয় পাবেন না তো ? 

-দাদিজিকে ধরে না ? 

-আরে দাদিজিকো সাথ তো উনলোগোকো দোস্তি হ্যায়। 

হা হা করে হেসে উঠল দীপেশ। 

   পারমিতা শুনেছে। শুনেছে সে ডাওহিলে নাকি অশরীরীরা চলে ফিরে বেড়ায়। অনেকদিন পর একটা রোমাঞ্চ অনুভব করল পারমিতা। এক ভিন্ন অনুভব। 

  হোটেলের যে ঘরটাতে সে আছে তার ঠিক পেছনের জানালার নিচে পাহাড়ি ঝোরা, আজ আকাশ স্বচ্ছ আর আকাশে এয়োদশীর চাঁদ। ঘরের আলো নিভিয়ে দিলে মনে হয় সাদা শাড়ি পরা এক চটুল নারী যেন নাচতে নাচতে উপর থেকে নেমে আসছে। পাহাড়ে ঝুলে আছে সাদা ম্যাগনোলিয়ার ঝাড়। চাঁদের আলোয় কী এক অপার্থিব পরিবেশ ছড়িয়ে আছে, মোহাবিষ্ট পারমিতার দীপেশ সুব্বার সরল হাসিমাখা মুখটা মনে পড়ল। একটা ভালো লাগা অনুভব। আবিষ্ট চিত্তে ঘুমিয়ে পড়ল সে। 

     একটি জিপ নিয়ে এসেছে দীপেশ। আজ আর ট্রাউজার্সের ওপর সাদা পাঞ্জাবি নয়, ছাইরঙা জিনসের ট্রাউজার্সের ওপর ঘন নীল টি শার্ট। খুব ফর্সা দীপেশ। বেশ লাগছে দেখতে। পারমিতা তৈরি হয়েই ছিল। 

জিপের পাশে এসে বলল - দাদিজি ? 

দীপেশ স্মিতমুখে বলে - দাদিজি চলে গেছে। গাড়ি পছন্দ নয়।

-কেন ?

-বলে গাড়ি চড়লে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাবে। 

দীপেশ একই সঙ্গে হিন্দি ইংরেজি বাংলায় কথা বলে। 

কোথা থেকে অপূর্ব এক গন্ধ বেরোচ্ছে। কেমন মাতাল করা গন্ধ। পাহাড়ি ফুলের গন্ধ। 

-আইয়ে। 

জিপের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে দীপেশ। সেই সরল হাসিমাখা মুখ। 

পারমিতা খুশি। খুব ভালো লাগছে। কেন কে জানে, এই জীপগাড়ি এই সাপের মত বেঁকে বেঁকে ক্রমশ উপরে উঠা এই মসৃণ পাহাড়ি রাস্তা, লম্বা লম্বা পাইনের সারি, ফার্ন, পিপল, শাল... আর গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে যে - দীপেশ সুব্বা... বড্ড ভালোলাগার... 

-ইয়ে দেখিয়ে ম্যাডাম লালিগুরাস, ইসকা আউর এক নাম হ্যায় - রডোডেনড্রন... " উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ " 

এবার পারমিতার অবাক হবার পালা। 

-আরে ! আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন ? 

-নেহি ম্যাডাম য়্যয়সা কুছ নেহি। ইধর মে ট্যুরিস্ট লোগ আঁতে হ্যায় না ম্যাডাম, তো ম্যয়নে উনলোগো সে কুছ কুছ সিখ লিয়া, ম্যয় গাইড ভি হুঁ... 

হিলকার্ট রোড ধরে এগিয়ে যেতে যেতে গাড়ি ডানদিকে মোড় নিল। 

-আচ্ছা, শুনেছি এখানে প্রেতাত্মার রাজত্ব। আপনাকে তো এখানে অনেকবার আসতে হয় নিশ্চয়ই, তাছাড়া আপনার দাদিজি তো আসেন, কখনও কিছু... 

-আপ তো খোদ যা রহেঁ হ্যায়, দেখ লিজিয়ে আপকো ক্যয়সা ফিলিংস হোতা হ্যায়... আই মিন এক্সপেরিয়েন্স…

যত উপরে উঠছে তারা ততই হালকা কুয়াশার মত মেঘ তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে… ভাসছে... সাঁতার কাটছে... 

   একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম ডাওহিল। পাশ ঘেঁষে ডাওহিল অরণ্য। দীপেশ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রায় ঝুলে থাকা একটি বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই কিছু নারীপুরুষের মুখ উঁকি দিল দরজায়, ঝোলানো পর্দা সরিয়ে। দীপেশ লেপচা ভাষায় কিছু একটা বলল। দুজন ভেতরে গেল। একটি কিশোরী কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। 

দীপেশ বলে - নেমে আসুন। পাহাড়ের গরম চা না কি কফি ? 

পারমিতা তো কফি ভালবাসে…

খুব পরিচ্ছন্ন গোছানো টেবিল চেয়ার, বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না এটা রেস্তরাঁ। 

এক লেপচা পুরুষ মোটা করে মাখনের প্রলেপ দেওয়া দু'পিস করে পাউরুটি দুখানা, ডবল ডিমের অমলেট ও দু কাপ গরম কফি এনে রাখল টেবিলে। 

দীপেশ হেসে বলে - লিজিয়ে ম্যাডাম। 

তারপর লেপচা ভাষায় লোকটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। 

বেশ ঠান্ডা। এটা সেপ্টেম্বরের শেষ। 

ওরা বেরিয়ে পড়েছে, আরও কিছুদূর এগিয়ে জিপটা একপাশে থামিয়ে ওরা নামল। দুজন পাহাড়ি যুবক বসে আছে। দীপেশ লেপচা ভাষায় কিছু একটা বলল। পারমিতা আন্দাজ করল সম্ভবত জিপটার দিকে একটু নজর রাখতে বলছে। তারপর পারমিতাকে বলল-এখন আমরা পায়ে হেঁটে যাব। 

যত এগোচ্ছে ততই নির্জনতা। পারমিতা জানে এখানে অনেক ঘুঘু জাতীয় পাখিদের বাস। লেপচা ভাষায় ঐ পাখিকে বলে "ডাও" - তাই এই পাহাড়ের নাম ডাওহিল। ঐ কথাগুলোই এখন দীপেশ বলতে বলতে যাচ্ছে। 

যতই এগোচ্ছিল তারা ততই নিবিড় অরণ্য ও নিঃসীম নির্জনতা এগিয়ে আসছিল ক্রমশই। মোহাবিষ্টের মত পারমিতা এগোচ্ছে, সে মিশে যাচ্ছে পাইন, ওয়ালনাট, শাল পিপুল ও লতাগুল্মেবেষ্টিত মোহময়ী এক অরণ্যের আকর্ষণে। পাতলা কুয়াশায় আবৃত হয়ে আছে চারপাশ, নির্জনতা যে এমন অদ্ভুত ও রহস্যময় হতে পারে ধারণা ছিল না পারমিতার। আরও কিছুদূর এগিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে দেখছিল, সে অনুভব করছিল, মনে হচ্ছিল প্রকৃতির এই নিবিড় একাত্মতার ভেতর সে ক্রমশ যেন আত্মস্থ হয়ে পড়ছে। 

   একটা অজানা পাখির তীক্ষ্ণ সুরে সম্বিৎ ফিরল তার, চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই তার সাথে। কোথায় গেল দীপেশ সুব্বা ? সে ডাকতে চাইল অথচ গলা দিয়ে একটুও স্বর বেরোল না। দীপেশ তাকে এখানে একা ফেলে চলে গেল ? মনে হল অরণ্যের নিবিড়তার ভেতর থেকে দুটো চোখ যেন তাকে দেখছে - চোখদুটি কি সেই লাল চোখ ? ডাওহিলের সেই লাল চোখ ? মনে হতেই তার গা ছমছম করতে লাগল। তবে সে অরণ্যের বাইরেই দাঁড়িয়ে, ভেতরে ঢোকেনি, কী ভীষণ আকর্ষণ ঐ অরণ্যের, সে আঁতিপাঁতি করে দেখছে ঐ দুটি চোখে.. হ্যাঁ মনে হচ্ছে কেউ তাকে দেখছে.. সেই দুটি চোখ... সেই দুটি চোখ কি সেই লাল চোখ ? এবার হঠাৎ মনে হল কুয়াশার ঘনত্ব বাড়ছে আর দীপেশ তার সাথে নেই। আতঙ্ক আবার তাকে গিলে খেতে এল। দু পা পিছিয়ে যেতেই তার কাঁধে সজোরে ধরল কেউ। ফিরে তাকিয়ে দেখে দীপেশ সুব্বা। সেই সরল হাসিমাখা মুখ। 

-ক্যয়সা লাগা ? হোআট অ্যান্ড হাউ ডু ইউ ফিল নাউ? 

পারমিতা অপলক তাকিয়ে আছে দীপেশ সুব্বার দিকে, নিশ্চল। 

একটু অস্বস্তির সাথেই পারমিতার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিল দীপেশ। 

বলল - আরে ! আপ তো ডর গ্যয়ে ! কুছ দেখনে কো মিলা ? 

পারমিতা এখনও কথা বলতে পারছে না। 

একবার সেই দুটি চোখ দেখার জন্যে অরণ্যে তাকাল সে। উহুঁ এখন নিরীহ গাছপালা কুয়াশা মেখে নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে। 

দীপেশ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল - চলিয়ে। শোচা থা আপকো ডেথ রোড সে ফরেস্ট অফিস তক লে জায়েঙ্গে। লেকিন আজ নেহি...আপনি তো ডরিয়ে গেছেন। চলুন ফিরে যাই। 

দীপেশের হাত ধরল না পারমিতা। 

রাগ করে বলল - একা আমাকে ফেলে কোথায় চলে গেছিলেন ? হাত ধরব না আপনার। 

দীপেশের সেই হা হা অনাবিল হাসি - আপনার কি মনে হয়নি অরণ্যের ভেতর থেকে কেউ আপনাকে দেখছে ? 

পারমিতা শিউরে উঠে। 

বলে - হ্যাঁ, তাই মনে হয়েছে। 

দীপেশ বলে - ম্যাডাম, প্রকৃতির প্রাণ আছে, ইয়ে পের চল নেহি সকতে... এজন্যে মানুষ তার ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করে। সে আপনাকে আমাকে বিশ্বাস করবে কেন ? 

-আসুন। আমার হাত ধরুন, মনে জোর পাবেন। ভয় নেই। আমরা মেয়েদের সম্মান করি, গাছপালা ভালবাসি, এই অরণ্যের পূজাও আমরা করে থাকি। ঐ দুটি চোখ ঈশ্বরের চোখ, ইনি গাছপালা বৃক্ষলতার ঈশ্বর। মানুষের হাত থেকে গাছপালাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আসুন। 

পারমিতা হাত বাড়িয়ে দেয়। দীপেশের হাত ধরতেই অপূর্ব এক প্রশান্তি অনুভব করে অনেক অনেকদিন পর।

বিজয়া দেব 
ব্বই এর দশক থেকে লিখছেন। মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তাঁর গল্প উত্তর পূর্ব ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, আমেরিকার ছোটপত্রিকা ও ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। গল্পগ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি - নীলাঞ্জনা(২০০৩), ভেদরেখা (২০০৫), ছায়াপথ (২০১২), কেমন আছে ভাস্বতী(২০১৭) কলকাতার প্রকাশনা 'এবং মুশায়েরা' ও শিলচরের 'দিনকাল প্রকাশনী' থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে ই-বুক "জোনাকির আলো" ।


Wednesday 1 June 2022

সংখ্যা ৩।। ১ জুন ২০২২ ।। চোখ || শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 চোখ 

শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় 

মাংসটা খারাপ দেয় না আলু হোসেন। হাট থেকে বেছে বেছে তাগদওলা খাসিগুলো ধরে আনে। আব্বার সুনামটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করে। নাচিন্দা বাজারে বুড়ি বটতলার নীচে তিরিশ বছরেরও বেশিদিনের দোকান আলুর আব্বাজান আসগর হোসেনের। চালু ব্যবসা আজও চলছে। তবে আগেকার মতো সেই রমরমা বাজার বোধহয় আর নেই। সময়ে ভাটা যে কিছুটা পড়েছে বুঝতে পারে আলু, যবে থেকে অসুস্থ আব্বার জায়গাটাতে সে বসতে শুরু করেছে। একথা সত্যি, আলুর বেশ কিছু পুরনো বাঁধা খদ্দের রয়েছে... যাদের জোরে ওর মাংসের দোকান আজও দাঁড়িয়ে...বাজারে অন্য অনেকের মতো খাসি বলে ছাগল গছিয়ে খদ্দেরকে টুপি পরানোর ব্যবসা করতে সে শেখেনি; হয়তো আব্বাই শেখায় নি। খরিদ্দার বেঁধে রাখতে পরিশ্রমও কিছু কম করে না আলু। তবু সে বুঝতে পারে কোথায় যেন ভাটা আসছে একটা। আগে যে আসগরের দোকান বলতে লোকে একবাক্যে এই দোকানটাকেই বুঝতো, এখন একই নামে বাজারে আরো একটা দোকান এসে গিয়েছে। টাকা যেমন বড় পিচ্ছিল, একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত আসা কঠিন। যত দিন যাচ্ছে, চোদ্দটা দোকান চষা পিচ্ছিল খদ্দেরের সংখ্যা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বৈ কমছে না...আলুর তো তাই মনে হয়। পয়সাকে বেঁধে রাখা তখন ভারি মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়...গোটা দুই খাসি বেচে, হাটবাজারের ঋণ শোধ করে যা যেটুকু থাকে দিনমানে বেরিয়ে যেতে মুহূর্তও লাগে না। বিকেল হলে ঝিল পাড়ে চোলাইয়ের ঠেকে গলা ডুবিয়ে ঘাম ঝরানো জীবনটাকে ভুলে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তখন। নেশার ঘোর কাটলেই আবার সেই চপার হাতে পরের দিনের লড়াই। 

রবিবারের ভরা বাজারের ব্যস্ততা আজ আলু'র দোকানেও। নটার মধ্যেই গোটা দেড়েক খাসি বিক্রি হয়ে গেল। আরো দুটো ছাল ছাড়ানো আস্ত বডি ঝোলানো রয়েছে আংটার দড়িতে। সামনে পাবলিকের লাইন দেখে আলুর মনে হচ্ছিল অন্যদিনের চেয়ে তার বেচাকেনা আজ অনেকটাই বেশি। মাংস কাটতে কাটতে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নেয় আলু, দূরে মাছের বাজারের পাশে টিনের ছাউনির নীচে ছোট আসগরের দোকানের দিকে। এখন মাছি তাড়াচ্ছে। কয়েক দিন ধরে এমনই চলছে ওর। ভোরের দিকে খাসি বেচে বেলা বাড়লে ছাগল মেরে ব্যবসা করার গোপন কারসাজি লোকে আর কদ্দিন না বুঝে থাকবে ! বুঝুক, আরো বেশি করে পাবলিক বুঝুক। আর এই সুযোগে সে আরো খানিক লাভের কড়ি ঘরে আনুক। একেক সময় আলুর মনে হয়, তার যাবতীয় লড়ালড়ি বুঝি ঐ ছোট আসগরের সাথেই...যাকে সামনে থেকে দেখা যায়, সহজে ধরাও যায়। এখান থেকে মাইল দেড়েক দূরে আলসে বাজার মোড়ে গোটা দুই-তিন সরকারি দাগ নম্বর লাগানো মাংসের দোকান আছে বটে, সে নেহাৎই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। 

'আগের দিন নিলেন... কেমন মাংস ছিল দাদা?'

' সেই জন্যই তো আবার ঘুরে ফিরে তোর দোকানেই এলাম রে। '

' আমিও অনেক দিন ধরেই আপনাকে দেখি বাজারে আসা যাওয়া করতে। একদিন সেই যে আমার কাছে দর করে চলে গেলেন...ভাবলাম বলি, "মাংসটা নিয়ে গিয়ে দেখুন...ঠকবেন না..." ভাবতে ভাবতেই দেখি পরের সপ্তাহে আপনি কিনতে চলে এসেছেন। আবার আসবেন দাদা। যারা আমার থেকে বরাবর কেনে তারা জানে মালে কোনো গড়বড় হতে আমি দেবো না। আমার আব্বাও দেয়নি।'

'আরে আলসে বাজারের মোড় থেকেই তো অ্যাদ্দিন কিনতাম। তো সেদিন এক বন্ধু হঠাৎ করে বললো তোর কথা। ভাবলাম একদিন না হয় নিয়েই দেখি। আজকেও একবার উল্টোমুখো হয়েছিলাম সাইকেলটা নিয়ে। কি মনে করে আর গেলাম না আলসে বাজার। হ্যাঁ, যেমন যেমন বললাম…ঐ...ঐ ওখান থেকে কাট...।'

' আর বলতে হবে না দাদা। সেদিনকার চেয়েও ভালো জিনিস আজ দিচ্ছি। খেয়ে দেখবেন শুধু। এ লাছুয়া, দাদার জন্য চা নিয়ে আয়।'

টাকা আর পয়সায় বেশ ভারি হয়ে উঠেছে লুঙ্গির খোঁটটা। ওগুলো বের করে ছোটো টিনের সুটকেসটাতে ভরে রাখছিল আলু। ছেলে ইস্কুলে যাবে বলে মা ফেরিওলার কাছ থেকে কিনে দিয়েছিল ঐ সুটকেস। 

' কি রোজ রোজ বই খাতা বগলে করে পড়তে যাস...এখন থেকে এই বাক্সে ভরে...।'

সেই মা'ই একদিন ফাঁকি দিয়ে কোথায় চলে গেল! আব্বার সাথে সাথে মাংসের দোকানে বসা শুরু করলো আলু। তখন থেকেই পয়সার মুখ দেখা। পয়সা চেনা। মায়ের দেওয়া সুটকেস খানা হারাতে চায় না আলু। সংসারের অমূল্য ধন করে রেখেছে। পয়সার সিন্দুক। কাল থেকে আবার হয়তো খরার মুখ দেখতে হবে। তার মাঝেই একটা নয় দু-দুটো বাঁধা খদ্দের তৈরি হয়ে গেল বোধহয়। মাগ্গিগণ্ডার দিনে এটুকুই বা কম কি ! তবে ঐ বছর কয়েক ধরে তো দেখছে সে, কিভাবে বাঁধা খদ্দেরও পিছলে পিছলে যায়। বাজারই যেখানে পিছল, খদ্দের তো পিছলাবেই। আব্বাজান বলতো,' টাকা হলো বরফের মতো। যতবার ধরতে যাবি জল হয়ে যাবে।'

আব্বা টাকা ধরেছিল, রাখতে পারে নি। মালের পেছনে বেহিসাবি পয়সা উড়িয়ে, শেষবেলায় পঙ্গু হয়ে এখন বিছানায় পড়ে। এক বছর হলো লাছুয়াকে কাজে রেখেছে আলু। সঙ্গে থাকে। সাহায্য করে দেয়। পয়সার তেমন খাঁই নেই। 

সুটকেসটা থেকে অল্প কিছু টাকা চোলাই খাবার জন্য সরিয়ে রাখতে গিয়েও সরালো না আলু। আজ আর সরিয়ে কাজ নেই। যেদিন পকেটে পয়সা আসে সেদিন আর মন চায় না ঐ ঠেকে গিয়ে নাড়া বাঁধতে। মন খারাপ থাকলেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছেটা চলে যায়। তখনই ছটফট করে ওঠে সে। বিড়ি ধরালো আলু। অনেক দিন পর এতগুলো পয়সার মুখ দেখলো। ছোট আসগরের দোকানে দুৃ'জন খদ্দের দাঁড়িয়ে। কম পয়সায় ছাগল কেনার পাবলিক। বাজারে এখন শেষ বেলার খদ্দেরের আনাগোনা। তবু মন বলছে আরো জনা কয়েক কাস্টমার আসার সময় এখনো যায়নি তার দোকানে। পাশেই বটগাছের ডালের সাথে একটা রেওয়াজি খাসি আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা রয়েছে ছায়ায়, আর থেকে থেকেই ব্যা ব্যা করে উঠছে। ওকে একনাগাড়ে খাইয়ে দাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করেছে আলু। কম দিন থাকলো ওর কাছে ! মায়া পড়ে গেছে। মায়া রাখলে চলবে কি করে ? সুস্বাদু জিনিস দিতে গেলে লোককে এমনই...। 

উল্টোহাতে ড্রেনের ধারে ফুটপাথে চট পেতে বসে কুচো, চারাপোনা মাছ বিক্রি করছে ভজা আর ওর ভাই কালা। পেছনে ভাঙা পেচ্ছাবখানা। ভ্যানভেনে মাছি। দূর্গন্ধ। লুঙ্গি তুলে ছরছর করে মুতছে লাছুয়া।

— ' শালা, এই নিয়ে কবার যে ঢুকলো...মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই ভরপুর চোলাই টেনে এসেছে।'

মনে মনে একটা খিস্তি দিয়ে রামদাটা নিয়ে একাই খাসিটাকে জবাই করতে এগিয়ে যায় আলু। আর তখনই চোখটা আটকে যায় সামনের দিকে তাকিয়ে। 

টাইট একটা জামা আর হাফ স্কার্ট পরে আসছে… সোজা রাস্তা ধরে আসছে মেয়েটা। এরকমই ছোট ছোট ঝুলের পোষাক পরে বাজারে আসে। রোজই আসে। অনেক দিন ধরে আসে। যবে থেকে চোখ টাটানো শুরু করলো আলুর, তারও আগে থেকে। তখন যেতো-আসতো বাবার সঙ্গে...ফুটফুটে ছিল, ভালো লাগতো। এখন একলাই ভালো লাগে। সবসময় যে একা আসে মেয়েটা তাও নয়। একটা ঢ্যাঙা লম্বা মতো ছেলের সঙ্গে বাইকে চেপে গায়ে গা লাগিয়ে মাঝে মাঝেই ঘুরে বেড়ায় এ রাস্তা ও রাস্তা। বোধহয় ওর প্রেমিক। ছেলেটাকে চেনে আলু। ওর বাপকেও চেনে। ঝিলপারের ওদিকটায় থাকে। চোলাইয়ের ঠেকে গেলে হামেশাই বসে থাকতে দ্যাখে বাপটাকে। মালের ঘোরে একদিন কাকে যেন বলছিল,-- ' আমার ছেলে আমার কথাতে ওঠে আর বসে…ওঠে আর বসে। বলে দিয়েছি, "বন্ধুরা মিলে গল্পগুজব করবি কর…যদি কখনো মুখ দিয়ে মালের গন্ধ বেরোতে দেখি, কিমা করে রেখে দেবো...ফূর্তি মারা বেরিয়ে যাবে"।

মনে মনে ভাবে আলু, ফাঁস করে দেবে কিনা ছেলের কীর্তির কথা। ছেলেটাকে কেন জানি না সহ্য হয় না ওর। মেয়েটার জন্য সহ্য করে নিতে হয়। থাক, কি দরকার ! শেষে চপারের ভয়ে এ রাস্তা মাড়ানোই হয়তো ছেড়ে দেবে। সাথে মেয়েটাও। চপার নামের জিনিসটা রূপ বদলালে কি হতে পারে, এখনো বোধহয় ভোলেনি এ বাজারের লোকে। সে অনেক দিনের কথা। তখন সবে একা একা দোকান চালাতে শিখেছে আলু। একবার হোলির দিন দুটো উটকো ছেলে মাল খেয়ে দোকানে ঢুকে সে কি বাওয়ালি ! সামান্য কিছু খুচরো ঠেকিয়ে বলে কিনা কেজি খানেক মালের চাট প্যাকেট করে দিতে হবে। মামাবাড়ির মোয়া! বচসায় জড়িয়ে মাথা ঠিক না রাখতে পেরে ঘুঁষি পাকিয়ে এগিয়ে আসা ছেলেটার দিকে চপারটা নিয়ে মারমুখি হয়ে ধেয়ে যায় আলু। মারতে হয়তো চায়নি৷ চেয়েছিল ভয় দেখাতে। তবু শানানো ফলার একটা আগা কোনো কারণে ছুটে এসে ছেলেটার বাঁ হাতের কবজি থেকে কিছুটা মাংস খুবলে নিয়ে চলে এসেছিল...যে ঘটনা আলুকে থানা পুলিশ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। তখন সদ্য নতুন দোকান দেওয়া ছোট আসগর এবং বাজারের আরো কেউ কেউ পুলিশের কাছে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে চেয়েছিল আলুকে প্যাঁচে ফেলতে। ব্যবসার ক্ষতি করতে। কিন্তু পাশে এসে দাঁড়ানোর লোকও কম ছিল না আলুর...বলা যায় তাদের সাক্ষ্যের জোরেই সে যাত্রায় নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে কোনোরকমে বেঁচে যায় সে। ছেলেগুলো সেদিনই বোধহয় চিনে নিয়েছিল তাকে। আর কোনোদিন এ মুখো হয় নি। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে আরো বেশি বিশ্বাস করতে শিখেছে আলু, লোকে তার সৎ ব্যবসার দাম দিয়েছিল বলেই আজও সে...। 

চিন্তাগুলো যেন হঠাৎই বাদল ঝড়ের মতো উড়ে চলে যায়। রাস্তা পেরিয়ে এদিকেই আসছে মেয়েটা দোকানের দিকে তাকাতে তাকাতে। সাথে বাঁকা চাউনি। মোচড়ানো ঠোঁটে অন্য কিসের ইঙ্গিত। চনমন করে ওঠে ভেতরটা আলুর! খেলাচ্ছে না তো ? হতে পারে। কবে যে তার দোকানে আসবে...! 

সামনে দিয়ে চলে গিয়েও কি মনে করে ফিরে এলো আবার। লেডি বার্ড সাইকেলটাকে রাস্তার ওধারে আমগাছের গা ঘেঁষে যে বুড়ো মুচিটা বসে আছে ওর আর এক পাশে এনে দাঁড় করালো। উঁচু নীচু খোয়াভাঙা ঢিবি রাস্তা। ঝাঁকুনিতে দুলে উঠল গায়ে গতরে শরীরটা। শানানো নজর ঘুরে বেড়ায় আলুর...চকচকে, সুঠাম পা থেকে ক্রমশ… খেলাতে চাইলে সেও খেলাতে জানে। সাইকেল রেখে এগিয়ে আসে মেয়েটা আলুর দোকানে এসে দাঁড়ায়।

আর কিছু দেখতে পায় না আলু। খদ্দের এসেছে। ভালো জিনিসটা দিতে হবে। ত্রস্ত হাতে গলার দড়িটা খুলে ছটফট করতে থাকা রেওয়াজিটাকে ছ্যাঁছরাতে ছ্যাঁছরাতে বটগাছের ঝুরির আড়ালে আগাছায় ঘেরা ঢালু জায়গাটাতে নিয়ে গিয়ে লাছুয়া আর ও মিলে পা দিয়ে দেহটাকে চেপে একেবারে মোক্ষম একটা কোপ দেয় ঘাড়ের কাছে। শেষ আর্তনাদটুকু বেরোনোর আগেই ঘুমিয়ে পড়ে প্রাণিটা। নতুন করে রক্তে লাল হয়ে ওঠে রামদাখানা। 

কাছে এগিয়ে আসে মেয়েটি, খুব কাছে। যে ছায়ায় এতক্ষণ নিঃশ্বাস নিচ্ছিল অবলা প্রাণি, সেই ছায়াটুকুতে এসে দাঁড়ায়...মাংসগুলো ভালো করে দেখে নিতে হবে যে!


শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় 

ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। পেশায় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে পার্শ্বশিক্ষক। বাংলা সাহিত্য পাঠ এবং গল্প লেখা অত্যন্ত প্রিয় কাজ। 

অলঙ্করণ শ্রী স্বর্ণেন্দু ঘোষ 



প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...