Wednesday 27 July 2022

সংখ্যা একাদশ।। ২৭জুলাই২০২২।।ছাপ।।শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 ছাপ 

শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

তিরিশ বত্রিশ বছর আগের কথা। ভিটে মাটি কেন্দ্রিক মফস্বল কাঁচরাপাড়া তখনো আমার চোখে দেখা জন্মভূমি। জমিজমা, বসতভিটে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেড়ে ওঠা মানুষজন, এক বাড়ির সঙ্গে আর এক বাড়ির অলিখিত সেতুবন্ধন, পাড়াঘরকে জড়িয়ে থাকা আবেগ... এই অভ্যস্ত জীবনের ছন্দময়তা সত্তর, আশির দশকের পথ ধরে নব্বইয়ের গোড়ার মানুষগুলোকে তখনো স্বাচ্ছন্দ দিত, আলো দিত, বাতাস দিত। চাহিদাকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপিত জীবনের অল্পবিস্তর ছোঁয়া সে জানলা দিয়ে যে একেবারে প্রবেশ করতো না এমনটা নয়, তবে সে ছিল পরিযায়ী মেঘ কিংবা দখিনা বাতাসের মতো সংসারের ছকে বাঁধা গন্ডীর মাঝে নিজেকে ফিরে পাওয়ার এক ভিন্ন মেরুর জীবন বোধ৷ 

অন্যের কাছে নিজেকে বিলিয়ে যে আনন্দটুকু পাওয়া যায়, সেরকমই এক আনন্দময় চরিত্রের মানুষ ছিলেন আমার জগন্নাথ জেঠু। সংসারে এমন ধরণের চরিত্র খুঁজে পাওয়া আজকের যুগ বা সমাজ কাঠামোয় দাঁড়িয়ে বিরলতম বললেও হয়তো অত্যুক্তি হয় না। যত দিন গেছে মহার্ঘ হয়েছে সময়, মহার্ঘ হয়েছে সেসব ভিন্ন মেরুর জীবন বোধ। 

যখনকার কথা লিখছি, সেটা নব্বইয়ের শুরু। এতদিন সেই শুরুর মানুষটির কথা মাঝেমধ্যে মনে পড়লেও লেখা আর হয়নি। লেখার তো কোনো বয়স থাকে না। তাই বোধহয় সঠিক সময়ও থাকে না। আজ তাঁকে নিয়েই আমার এই লেখা। 

জগন্নাথ জেঠু আর আমরা একই পাড়ার বাসিন্দা। জেঠুদের বাড়িটা দেখলে সত্যিই যেন মনে হয়, না জানি কতকালের পুরোনো !  

যবে থেকে চোখ মেলে পৃথিবীকে দেখতে শিখেছি তবে থেকে, বলতে গেলে এই সেদিন পর্যন্ত বাড়িটার দেওয়ালের আবছা রঙটুকুই আমার দৃষ্টিপথে চিরনবীন হয়ে থেকে গিয়েছে। ছাদের ভাঙা কার্ণিশ, মরচে ধরা জানলার গরাদের নীচের স্তরে ভগ্নপ্রায় দেওয়ালের অংশ, প্লাস্টার খসা রেলিংয়ের শ্যাওলা ধরা ইট পাথরের খাঁজ বরাবর যত্রতত্র বেড়ে ওঠা লতাপাতা, আগাছার শিকড়, বাইরে থেকে দেখা সিঁড়ির ঘরের ফুটিফাটা ধূলিধূসরিত কাচের শার্সি...এগুলোও যেন আমার শৈশব থেকে দেখে আসা ঐ বসতভিটারই আরও এক চিরনবীন চিত্র...যে বাড়ির বহিরঙ্গের চেহারাটা নেহাৎই জোড়াতালি দেওয়ার মতো সময় সময় হয়তো বা উনিশ বিশ বদলালেও মোটের ওপর জগন্নাথ জেঠুদের ঐ ফ্যাকাশে লাল রঙের দেওয়ালটা আর কাঠের নড়বড়ে সদর দরজার কিছুটা ওপরে শ্যাওলা ধরা আলসের গায়ে পাথরের সাইনবোর্ডে লেখা ' ইন্দিরা ভবন' নামের প্রায় উঠে যাওয়া ঝাপসা কালো কালির হরফগুলো যত দিন গেছে, মনের গভীরে তৈরি হওয়া চক্রবর্তী বাড়ির ছবিটাকে তত বেশি করে সিম্বলাইজ করে তুলেছে। 

বাবা বলতেন, ' ও বাড়ির বয়স আমাদের বাড়িরও আগেকার। জগন্নাথ দা'র বাবা বিষ্টু চক্কোত্তি সে আমলে যজমানি করে বেশ কিছু পয়সা করেছিলেন... তেজারতি কারবারি গৌর সাঁধুখার কাছ থেকে হাজার টাকার বিনিময়ে জমিজমা সমেত দোতলা বাড়িটা কেনেন। আমরা আর বিষ্টু চক্কোত্তিরা তখন নকড়ি মন্ডল রোডের পুরোনো পাড়ায় পাশাপাশি দু বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। তখন থেকেই আমাদের ও বাড়ির বাঁধাধরা পুরোহিত ছিলেন বিষ্টু, সেই সূত্রে বাবার সঙ্গে বহুদিনের পরিচয়। চক্কোত্তিই বাবাকে নিয়ে এসেছিলেন এ পাড়ায়...উনি বাড়ি কেনার পরের বছর গৌড় সাধুঁখার থেকেই বাবা এই জমিটা কেনেন...তারপর ধীরে ধীরে মাথা গোঁজার মতো একটা ভিটে তৈরি হলো আমাদের ...চিলতে রোয়াক আর একটা মাত্র ঘর...সেসব কতকালের কথা! ভাবলে মনে হয় একশো বছর পেছনে ফেলে এসেছি ! বিষ্টু চক্কোত্তি যা যেটুকু সম্পত্তি করে দিয়ে চলে গেল, তার ওপর বসে জগন্নাথ দা বাপের সম্পত্তি ভোগ করেই জীবন কাটিয়ে দিল...এই তো সেদিন গেছিলাম সরস্বতী পূজোর ফর্দ নিয়ে আসতে আর কথা বলতে...অনেক আগে মেশোমশাই থাকাকালীন বারকয়েক গেছি, ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরেও গেছি...তখন কিরকম ছিল সে বাড়ি, আর এখন কি হাল হয়েছে ঘর দোরের...স্যাঁতসেঁতে নোনা ধরা দেওয়াল, রাজ্য জুড়ে উঁইয়ের ঢিবি, ঘুণে খাওয়া কাঠের জানলা...বাইরে থেকেই যা অবস্থা দেখি ! কি আর করবে...যজমানি করে ঐ যা দুচার পয়সা হয়...বাপের মতো রাজ্যপাট তো আর খুলে বসতে পারলো না। ও বাড়ি মেরামত করতে গেলে এখন খোলনলচে বদলাতে হবে...গিয়ে দেখি ছাদে উঠে খুরপি দিয়ে দেওয়ালের আগাছা কাটছে জগন্নাথ দা...আমায় দেখে হেসে বলে, " ভাবি ঝেঁটিয়ে দূর করবো...আবার কি করে ঠিক গজাবে...শিকড় ওপরাতে গেলে দেয়াল খসাতে হবে...পরগাছাগুলো বোধহয় বাকি জীবনটা ভিটে আঁকড়েই পড়ে থাকবে..."

কথাটা বেরিয়েই এলো মুখ থেকে , " বাড়িটা ছাড়ুন..."

বলে কিনা, " তোমাদের ছেড়ে যাবোই বা কোথায়...গেলেই তো মুখগুলো মনে পড়বে..."

অদ্ভুত লোক...!'

এই অদ্ভুত লোকটার বাড়ির বাগানে স্কুল ফেরত বিকেলবেলা কতই না খেলাধূলা করেছি, ছুটোছুটি করেছি, ক্যাম্বিস বল নিয়ে ড্রপ ক্যাচ খেলতে খেলতে ফ্যাকাশে বিবর্ণ দেওয়াল আরো বিবর্ণ হয়েছে শরীরময় বলের ছোপে, ফাল্গুণ পড়তে না পড়তেই বাগানের কুলগাছগুলো প্রায় সাফা হয়ে যেত আমাদের সৌজন্যে...জৈষ্ঠ্যের খরতপ্ত দুপুরে খেলতে খেলতে ঢিল মেরে আম চুরী করা...সে উপদ্রবও কি কিছু কম করেছি জগন্নাথ জেঠুদের জমি বাগানময়! সেসব নিয়ে ঠাকুমা মানে, জেঠুর মায়ের গালমন্দ যেমন কম খাই নি, সেই গালমন্দ খেয়ে দুদিন হয়তো ভয়ে আর বাগানেই যেতাম না ...কোত্থেকে জেঠু এসে আবার আমাদের ধরে নিয়ে আসতেন...' কি রে খেলতে যাস না কেন আর ? '

' ঠাকুমা যদি লাঠি নিয়ে তাড়া করেন আবার ?'

' দুষ্টুমিটা বুঝি একটু বেশিই করে ফেলেছিস? যাস, তোদের জন্য মা কুলের আচার করে রেখেছে...'

সত্যিই যেন অবাক হয়ে গেলাম। ঠাকুমা যে আমাদের প্রতি এতটা সদয় তা তো আগে বুঝি নি ! 

ব্যাস ঐ শুনে পরের দিন থেকে আবার পাড়ার কচি কাঁচারা সদলবলে জেঠুর বাগানে।

বুড়ি মাকে নিয়ে বাড়িটাতে একাই থাকতেন জগন্নাথ জেঠু। মাঝে মাঝে জেঠুর এক বিয়েওলা বোন দথু পিসি না কি জানি নাম, তিনি আসতেন কালেভদ্রে। এছাড়া কোনোকালে জেঠুর আর কেউ ছিল কিনা, আমি দেখি নি।

জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি জেঠুকে দেখেছি আমাদের বাড়ির পুজো-আচ্চায় পৌরহিত্য করতে। ফি বছর সরস্বতী পূজার আগে বাবা সাততাড়াতাড়ি জেঠুর বাড়িতে চলে যেতেন, ফিরে এসে যেন হাঁফ ছাড়ার ভঙ্গিতে বলতেন, ' ছোট চক্কোত্তিকে বলে এলাম...সকাল সকাল পুজোয় বসবে...পাড়ায় এখন ছোট বড় অনেকেই যজমান বনে গিয়েছে...আগের সে দিন নেই যে বিষ্টু চক্কোত্তির মতো সবাই একটাই পুরোহিত ধরে বসে থাকবে...তবে কি জানো গিন্নি, বড় চক্কোত্তি ছিল আমাদের একসময়ের কুলপুরোহিতের মতো...তাই বোধহয় ছোট চক্কোত্তি যখন এ বাড়ির পুজোয় বসে, অদ্ভুত শান্তি পাই...হুলো এদিকে একটু শোন...'

ঠিক তখনই আমার বুকের ভেতরটা ধরাস করে ওঠে...এই রে গতকাল আমরা তিন বন্ধু মিলে জেঠুর বাগানের গুচ্ছ গুচ্ছ কুল চুরি করে পালাতে গিয়ে বুড়ি ঠাকুমার হাতে ধরা পড়ে গেছিলাম ! অপরাধ কি একটা ! জগন্নাথ জেঠুর দেওয়ালে বল থ্রোয়িং প্র্যাকটিস করতে গিয়ে গাবলুটা সিঁড়ির ঘরের শার্সির কোণের দিকের খানিকটা অংশ বেয়ান্দাজে বলের ঘায়ে ভেঙেই দিল শেষমেশ....আর ঠিক তখুনি বুড়ি ঠাকুমা কোথা থেকে এসে...' কে রে ? ও কিসের ঝনঝন আওয়াজ ! গাবলুটা ওরকম পালাচ্ছে কেন রে? কি করেছে হতচ্ছাড়া? ও মা গো...দ্যাখ দ্যাখ, জগন্নাথ, তাকিয়ে একবার দ্যাখ...তোর বাবার আমলের কাচের জানলাখানা...!'

সেসব কথা ভাবছি আর প্রহর গুণছি,এই না বাবা এবার বলতে শুরু করেন...' কাল তোরা কুল চুরি করতে গেছিলি? মাসিমা আমার সামনে খ্যাকম্যাক করে উঠলেন...তোদের জন্য এবার কি আমায় অন্যের কাছে বেইজ্জত হতে হবে ? '

সে প্রসঙ্গে বাবা যখন কিছুই বললেন না, তখন আমিও একপ্রকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম বটে, কিন্তু দিন দুই পরে জগন্নাথ জেঠু যেদিন আমাদের বাড়ি এসে আমায় বলে গেলেন, ' যাস, তোদের জন্য মা কুলের আচার বানিয়েছে...'

 বাবা খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, ' এই বয়সে, এই শরীরে মাসিমা এখনো যে কি করে এত কিছু করে চলেছেন ভাবলে সত্যিই...! '

'সেটা কে কাকে বোঝাবে বলো? এই তো সেবার কি জ্বরেই না পড়লেন! কবে থেকে বলে আসছি, 'রান্নাবান্নার জন্য এবার একটা লোক রেখে দিই...আশপাশের বাড়িতে যারা কাজটাজ করে, কথা বলে দেখি না একবার ...'

বলে, "ওসব অজাত কুজাতকে ধরে আনবি, আর আমি তাকে সদর দরজার চৌকাঠ পেরোতে দেবো, ভাবলি কি করে ? ধম্মের নামাবলি পরে পরকালে তাঁর কাছে কী জবাব দিবি? ওনার ভিটেতে আমি এসব করতে দেবো না..."

' এর পর আর কি ই বা বলার থাকতে পারে! ঈশ্বর কোথায় বাস করেন...ঘরে না বাইরে...সে অস্তিত্বের সন্ধান করতে করতে পিতৃদেব একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন...সেখানে দাঁড়িয়ে আমিই বা মাকে কি করে বোঝাবো, সে সাধ্য কি আর আছে !'

জ্ঞান হবার পর যবে থেকে জেঠুদের বাগানে গিয়ে খেলতে শিখেছি, তবে থেকে লাঠি হাতে ঠকঠক করতে করতে কোলকুঁজো হয়ে চলা ঠাকুমার হাঁক ডাক টাই কেবল শুনে আসছি। সেই ঠাকুমা কখনো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, এ যেন আমাদের অভ্যস্ত চোখের ধারণার বাইরে। মানুষের জীবন, বার্ধক্য, বয়স জনীত অসুস্থতা..এসব নিয়ে ভাবার মতো বা কাছ থেকে দেখার মতো চেতনার স্তর খুব স্বাভাবিক নিয়মেই তখন আমার মধ্যে গড়ে ওঠে নি। ঘন্টা কয়েকের খেলাধূলার মুহূর্তময়তার মাঝে জড়ানো জগন্নাথ জেঠুর বাগানখানা যতখানি চেনা এক উজ্জ্বল ছবি,ঠিক ততখানিই অচেনা সে বৃত্তের বাইরে পড়ে থাকা জীবন চেতনার স্তর।

সে জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে ' তোদের জন্য মা কুলের আচার বানিয়েছে...' আমার মনের অন্তঃকরণে ভেসে ওঠা সেদিনের ঠাকুমার ছবিটা যেভাবে আমায় বিস্মিত করে তুললো, তেমনটা অবাক এর আগে আমি কখনো হয়েছি কিনা সত্যিই মনে পড়লো না। 

একগাল হেসে জেঠু এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ' তোরা একদিন খেলতে না এলে বাগানটা আমার খাঁ খাঁ করে...ওদের জন্য অপেক্ষা করে থাকি বুঝলে না? ওরা খেলা শেষ করে বাড়ি যায়, তবে আমি ঘরে গিয়ে জপ আহ্নিকে বসি...ওদের দাপাদাপিতে মা ও একটু হাঁক ডাক করার সুযোগ পায়...নয়তো বাড়িটা কেমন নিষ্প্রাণ... '

শেষের কথা গুলো বাবার উদ্দেশ্যে। 

' কোনো দুষ্টুমি করেছে নাকি ?'

বাবা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসেন। ভয়ে কুঁকড়ে যাই আমি। সেদিনের কথাটা বলবার জন্যই কি জেঠু আজ আমাদের বাড়ি ছুটে এসেছেন? সর্বনাশ ! 

' না না ও কিছু না। খেলতে গিয়ে বাচ্চারা একটু আধটু দুষ্টুমিই যদি না করে...ওদের সময় আমরা কেমন ছিলাম একবার ভাবো তো হে ধীরাজ...এখন আর ছেলেপিলেরা খেলবার সুযোগ তেমনটা আর পায় কোথায় ! মাঠঘাট কত কমে আসছে...পাড়ার ভেতর ওরাই তো আমার চৌহদ্দিটাকে জাগিয়ে রেখেছে...ইয়ে, একটা বিশেষ খবর দিতে এলাম ধীরাজ...বাজারে গিয়েছিলাম, ভাবলাম বলেই যাই...'

জেঠু যে অনেকক্ষণ থেকেই কিছু একটা বলবার জন্য উসখুস করছিলেন, এটা আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। কী আবার খবর? কৌতুহল যে কিছুতেই কেটেও কাটতে চাইছে না আমার! 

জেঠুর হাতে একটা বাজারের থলে ব্যাগ। আর এক হাতে ছাতা। ঘাড়ে, কপালে অল্প অল্প ঘামের চিহ্ন। মুখময় কিসের যেন একটা উত্তেজনা। 

বাবা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন...' আরে পাখার তলায় বসুন জগন্নাথ দা, ওখানে কেন ! হ্যাঁ গো, ঠান্ডা জলবাতাসা এনে দাও..জগন্নাথ দা এসেছেন... '

' না না ঠিক আছে। অত ব্যস্ত হতে হবে না। কিভাবে যে বলি, তাই ভেবে পাচ্ছি না...'

জেঠুর চোখে মুখে সলজ্জ হাসি। কথায় ইতস্তত ভাব। 

' কী হয়েছে দাদা ?'

' টিভিতে কালকে রবিবার দুপুরের সিনেমাটা দেখো..."লাল্টু বল্টু"...ছোটোদের খুব ভালো লাগবে...হুলো দেখিস কিন্তু... '

আমার সবাই না বুঝে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি জেঠুর মুখের দিকে। 

' তাহলে বলি...ওতে মানে, সিনেমাটাতে আমিও একটা বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছি...'

' তাই নাকি ?'

' এতদিন তো বলোনি জেঠু !'

আমি বিস্ময়ের সুরে বলে উঠি।

' বলবো কি রে ! এই তো সদ্য সদ্য বেরোলো ছবিটা...আমি নিজেই দেখে উঠতে পারিনি।'

' এমন একটা জায়গায় কি করে যোগাযোগ হলো দাদা ?'

বাবার চোখেমুখেও যেন আমারই মতো সমান কৌতুহল।

' হে হে..সে এক ইতিহাস বটে ! '

জলের গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে আনন্দ, উত্তেজনা আর চঞ্চলতায় কিছুট জল চলকে পড়ে জেঠুর খদ্দরের পাঞ্জাবীর বুকে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে বলে চলেন তিনি...' ঐ সিনেমার যে সহনায়ক, মানে ঐ বল্টু...ওরফে হীরক চন্দ্র মল্লিক, ওর বাপ জেঠারা আমার মায়ের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হন...একই বংশের লতায় পাতায়..। একটা সময় ওদের বাগবাজারের বাড়িতে পূজার্চনায় বাবার হামেশাই ডাক পড়তো। তারপর সময় বদলে গেলে যা হয়...ও বাড়ির ছেলে হীরক এখন সিনেমায় নাম করেছে...বড় অভিনেতা...দিন পালটে গেছে... এখন ওরাও ডাকে না, আমরাও আর যাই না। মাস কয়েক আগে হঠাৎ করেই সে বাড়িতে যাওয়ার একটা সুযোগ আমার এসে গেল। ভাটপাড়ার প্রখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তি প্রণবেশ ভট্টাচার্য ছিলেন বাবার আচার্যগুরু। তাঁর কাছেই বাবার মন্ত্র সাধনার হাতেখড়ি। প্রণবেশ পুত্র পন্ডিত নিখিলেশ ভট্টাচার্য, তিনিও একজন সিদ্ধ পুরুষ। ছয়ফুটের ওপর লম্বা, অন্তর্ভেদি দৃষ্টি, জটাজুটোধারী, পাকা আমের মতো গায়ের রঙ। পূর্বপরিচয়ের সূত্রে মাঝে মাঝে তাঁর কাছে আমি যাই।

প্রাণের আরাম আর মনের শান্তি দুটোই যেন ফিরে ফিরে পাই সেখানে গেলে, দুদন্ড কথা বললে। 

শেষ যে বার তাঁর কাছে আমি গিয়েছিলাম, আমায় বেশ উদ্বিগ্ন চিত্তে বললেন, " কলকাতায় কাল এক বাড়িতে শ্রাধ্যানুষ্ঠানের কাজ করতে যেতে হবে। আমার সহকারীটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার যাওয়া ঘোরতর অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমি কি পারবে আমার সঙ্গে যেতে সেখানে ? "

" কলকাতার কোথায় গুরুদেব?"

" বাগবাজার.."

ঠিকানা শোনামাত্র আর বুঝতে বাকি রইলো না। একদিন যে বাড়িতে বাবা যেতেন প্রধান পুরোহিত হিসেবে, আজ আমি সেই বাড়িতেই যাচ্ছি সম্পূর্ণ অন্য এক পরিচয়ে। তবু গুরুদেবের কথা, ফেলবোই বা কেমন করে! রাজী হয়ে গেলাম। 

শ্রাদ্ধশান্তির পালা চুকিয়ে যখন ফিরে আসছি, হীরক আমায় একপাশে ডেকে বললো, " মামা, একটা প্রস্তাব ছিল। অন্য কাউকে তো চাইলেই বলা যায় না। আত্নীয়তার সম্পর্কের খাতিরেই বলছি..."

যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওদের বাড়ির আগামী প্রজন্মের কাছে এই আত্নীয়তার সম্পর্কের সত্যিই আর কোনো মানে থাকবে কিনা জানি না। সেটা জানি না বলেই এ বাড়ির প্রতি জড়ানো আবেগটুকু সদ্য প্রয়াত কাকাবাবুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মনের এক কোণে সঞ্চয় করে রেখেছিলাম। পুরোনো মানুষেরা এক এক করে সব হারিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে এখনই কেউ কারো খোঁজখবর রাখে না তো তখন! শুনলাম সিনেমা, ছবিপত্র করে হীরকের এখন বেশ নাম ডাক হয়েছে। হাজার হোক, নিজেদেরই তো জন৷ কোথাও একটা ক্ষীণ সুতোয় বাঁধা। সেখানে দাঁড়িয়ে ওর এই কথাটুকু শুনে ভালো যেমন লাগলো, কৌতুহলও হলো৷ 

জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। সে আমায় বললো, " একটা সিনেমার শুটিং চলছে মামা। পরিচালক আশিস সিনহার ছবি..." লাল্টু বল্টু"...ছোটোদের জন্য তৈরি...আমি সেখানে বল্টুর চরিত্রটা করছি। সহনায়কের পাট।'

শুরুতেই ঠোক্কর খেলাম। ব্যাটাচ্ছেলে পর্দায় অভিনয় করে শুনেছি...কবে যে নায়ক হয়ে গেল, এ তো জানা ছিল না! কটা সিনেমাই বা দেখেছি জীবনে! এখন বয়স হয়েছে, সন্ধ্যেটা কাটাতে মায়ে পোয়ে টিভির সামনে খানিক বসে থাকা..ঐ আর কি...কি যে দেখি ছাই মনেও থাকে না...তবে কি জানো, অনেক ছোটোবেলার একটা ঘটনা...সে ঘটনার সঙ্গে আজকের সময়ের কতটা কি যোগসূত্র আছে আমি জানি না, তবে ঐ যে কথায় বলে না, কারণে অকারণে ছোটোবেলা ঠিক ফিরে ফিরে আসে, কাকতালীয় ভাবেই আসে...!

তখন কত বয়স ঠিক খেয়াল নেই। শ্রী লক্ষী সিনেমা হলটা নতুন তৈরি হয়েছে। ধারেকাছে তখন আর কোথাও কোনো প্রেক্ষাগৃহ হয়ে ওঠে নি। 

একদিন বাবার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে নজর পড়াতে তাকিয়ে দেখি সিনেমা হলের মোটা মোটা থামওয়ালা দেওয়ালের গায়ে অনেকখানি উঁচুতে একটা বিরাট বড়সড় রঙচঙে ছবি আঁকা পোস্টার সাঁটানো রয়েছে। গাছপালা, কুঁড়েঘর, মাঠ, দূরে কাশবন, নীল আকাশ...দুটো বাচ্চা বাচ্চা ছেলে সেই কাশবনের পথ ধরে ছুটতে ছুটতে আসছে...এইরকমই ছিল ছবিটা...তার নীচে বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা... " দুই ভাইয়ের গল্প নিয়ে তৈরি ছোটোদের জন্য সাড়া জাগানো ছবি লাল্টু বল্টু.."

সিনেমা হলের সামনেকার চৌহদ্দিটাকে ঝলমলে কাগজ আর রঙীন কাপড়ের মোড়কে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। অনেক লোকও হয়েছে সেখানে। 

যাবার পথে পাশ থেকে কে একটা বাবাকে বললো, "আজ প্রেক্ষাগৃহের শুভ উন্মোচন..."

খানিক দাঁড়িয়ে পড়লেন বাবা। আমি তাকিয়ে আছি। আমার মতো তাকিয়ে আছে আরো অনেকেই। চলতে ফিরতে কম বেশি সবারই নজর যেন একবার করে হলেও ছুঁয়ে যাচ্ছে পোস্টার ঘিরে। হবে নাই বা কেন। সে পোস্টার এতটাই পেল্লায়, বাবার মতো লম্বা মানুষটাকেও যে ছাড়িয়ে যায়...! 

জীবনে সেই প্রথম অন্য রকম চোখ দিয়ে সিনেমা দেখা...!

কে অভিনেতা, কে পরিচালক, কে কি কিচ্ছু মনে নেই...শুধু ঐ গায়ে আঁকা দৃশ্যপট আর লাল অক্ষরে নামটুকু কি করে যেন এখনো ভেতরকার পৃথিবীতে গাঁথা হয়ে আছে..!

হয়তো নাড়াচাড়া না করলে হদিশও পেতাম না সে ছবির...

আজ এত বছর পর বাগবাজারের বাড়িতে দাঁড়িয়ে কি মনে হলো জানো ? মনে হলো, সেদিনের ঐ ছবিটুকুই যেন স্পটলাইটের আলো হয়ে হীরক, মানে আমার ভাগ্নের চারপাশে হীরের মতো জ্বলজ্বল করছে এদিক ওদিক....! হয়তো শেষমেশ দুটো সিনেমাকে কখনই এক করা যাবে না। না ই চিনলাম আশিস সিনহাকে। তবু কি অদ্ভুত একটা টান! একাল আর সেকাল। মাঝখানে ছোট্ট দুটো শব্দ... "লাল্টু বল্টু".... কি অদ্ভুত রকম নস্টালজিক ! 

ভাগ্নে আমার চোখ বড় বড় করে বললো, " ঐ যাঃ, আশিস দার নামই শোনোনি? আচ্ছা বেশ, শুনে কাজ নেই..."

এরপর যেটা বললো, তা শুনে তো আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম! এ যে নস্টালজিয়ারও ঊর্ধ্বে...! 

বললো, "ঐ ছবিতে একটা রোল আছে। পুরোহিত মশাই বিয়ের বাসরে মন্ত্র পড়ছেন। পাট খুব ছোট। কিন্তু জিনিসটা ফুটিয়ে তুলতে হবে। সেরকম একজন লোক চাই...কথায় কথায় ডিরেক্টর বলছিলেন আমায়। আজ তোমাকে দেখে হট করে আমার ভদ্রলোকের কথাটা মনে পড়ে গেল। তুমি যদি রাজী থাকো তাহলে আমি তোমার কথা বলতে পারি। তেমন পারিশ্রমিকও মনে হয় দিতে পারবে না। ঐটুকু রোলের জন্য কি আর দেবে। আশিস দার ছবিতে চিলতে জমিটুকুই অনেক। ছাপ রাখতে পারলে পরবর্তী কালে আরো কাজের অফার...তাহলে মামা..."

বেজায় খুশি মনে জগন্নাথ জেঠু বললেন, ' ভাগ্নের কথায় রাজী হয়ে গেলাম বুঝলে হে ধীরাজ... না আছে কস্মিনকালে কখনো যাত্রা, থিয়েটার, নাটক পালা করার অভিজ্ঞতা, না আছে স্পটলাইটের মুখের সামনে এক খন্ড দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা...অনেক কাল আগে একবার বাদাবনের দিকে কোন্ এক গেরো মাতালের চরিত্রে একজনকে অভিনয় করতে দেখেছিলাম...আশু ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে তখন নিত্য পুজা করতাম...ফিরে আসার পথে ভীড় দেখে দাঁড়িয়ে পড়াতে তালগাছের সারির ফাঁকে দেখি ঐ দৃশ্য...বোধহয় সিনেমার শুটিং...পাশ থেকে কে একজন বলেছিল, " কত কসরত করলে তবে এই মোদোমাতালের চরিত্র...এলেম ছাড়া এমন পাট করা যায় না..."

সেকথা মনে করে চাইলেই হয়তো পিছিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু ঐ মনটাই আমায় আটকে দিল। ভাবলাম, পিতৃদেবের আশীর্বাদে আজ আমার যেটুকু আছে, তা ই বা কজনের থাকে ! ভান্ডারে এই সঞ্চিত আছেটুকু...এ তো আমার নিত্যদিনের রিহার্সাল ! দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে চাওয়া...ইহজীবনে এর চেয়ে কসরত আর কি হতে পারে ? সারাজীবন যজমানী করে কাটিয়ে দিনের শেষে ঐ অভিনয়টুকু করতে পারবো না ! এর চাইতে চ্যালেঞ্জিং কাজই বা আর কি হতে পারে ! মাস দুই আগে শুটিংও করে এলাম। সেই ছবিই কাল টিভিতে...তাই ভাবলাম যাই, পাড়ায় একটু খবরটা দিয়ে আসি...এই তোমাদেরই প্রথম বললাম...আচ্ছা আসি তাহলে...'


পরদিন দুপুর বেলা তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে বাড়ি শুদ্ধ সকলে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রয়েছি টিভির দিকে। না জানি আজ কি একটা ঘটতে চলেছে ! 

সময় যত এগোতে থাকে ততই যেন অধৈর্য হয়ে উঠি ভেতর ভেতর...

 কই, জগন্নাথ জেঠুর মুখ কিংবা কোনো অবয়বই তো এখনো অবধি কোথাও দেখতে পেলাম না! 

' ও বাবা, জেঠু কোথায় ?'

বাবা পাশ থেকে বলেন, ' দ্যাখ না, এবার হয়তো আসবে...ঐ, ঐ তো একটা বিয়েবাড়ি দেখাচ্ছে...দ্যাখ দ্যাখ ভালো করে দ্যাখ, ফসকে না যায়...!'

চোখ বড় বড় করে গরু খোঁজার মতো খুঁজেও জগন্নাথ জেঠুর কোনো হদিশ কোত্থাও পেলাম না। দেখতে দেখতে সিনেমার অবশিষ্ট সিকিভাগ চলে গিয়ে একসময় অপেক্ষা করার মতো আর কিছুই রইলো না। 


পরের দিন সকাল বেলা ইস্কুলে যাবার পথে সাইকেলটা থামিয়ে বলতে গেলে এই প্রথম জগন্নাথ জেঠুর বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম একটা অন্যরকম আবেগে।  

সদর দরজার চৌকাঠে পা রেখেছি, দেখি বারান্দার তুলসি মঞ্চের সামনে গেরুয়া বসন পরে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে জপতে কমন্ডলু করে গাছে জল দিচ্ছেন জেঠু। 

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। 

আমায় দেখে ঘাড় ফেরালেন জেঠু। সেই একগাল হাসি। বেশ খানিকটা অবাকও। 

' আমাদের হুলো বাবু যে! এত সকালে? আয় আয় ভেতরে আয়...'

সসংকোচে এদিক ওদিক তাকাই...' ঠাকুমা কোথায় জেঠু ?'

' মা দোতলায় আহ্নিক করছে। ওমা, দাঁড়িয়ে রইলি কেন ? আয়।'

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে খানিক ইতস্তত করে বলি...' কাল তো টিভিতে দেখতে পেলাম না তোমায়...কত খুঁজলাম!'

কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে খানিকটা সময় তাকিয়ে রইলেন তিনি। মাথাটা আস্তে আস্তে নীচু হয়ে আসে তাঁর। অতি ধীর কন্ঠে বলেন, ' নারে, শেষমেশ কেটেই দিল। হয়তো ওটুকু দৃশ্য রাখতেই ভুলে গেছে।'

কি আর বলি। চুপ করে রইলাম। 

জেঠু আমার গায়ে হাত রেখে বললেন, 'হুলো বাবা, দুপুরে খেলতে আসিস কিন্তু...কুলের আচার নিয়ে যাস...ভাগ্নের সিনেমা বলে কথা, সেখানে আবার আমায় ছবির পর্দায় দেখবে,তাই শুনে তোর ঠাকুমা আনন্দে দুই বোয়াম আচার বানিয়ে রেখেছিল...তোরা না এলে কষ্ট পাবে...'

মাথাটা কেন জানি না আমারো নীচু হয়ে আসে। 

ভেবেছিলাম সেই গোপন ইচ্ছের কথাটা পাড়বো...'হীরক মল্লিকের সঙ্গে একবার একটু দেখা করার সুযোগ করিয়ে দেবে জেঠু ?'

পারলাম না বলতে। মন থেকে কথাটা এলোনা, নাকি বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না জানি না। 

সেদিনের পর বলার মতো পরিস্থিতি জীবনে যে আর কখনো আসে নি এমনটাও নয়। কিন্তু ঐ আসাটুকুই। 

ইষ্টনাম জপতে জপতে জগন্নাথ জেঠু একদিন ইহলোকের মায়া কাটিয়ে স্বর্গলোকে যাত্রা করেন। 'বল্টু'র পৃথিবী থেকে দূরে, আরো দূরে হয়তো বা অন্য কোথাও...অন্য এক স্পর্শের মাঝে বেঁচে থাকে অভিনেতা। ঝাপসা হতে হতে জীবনের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় অপ্রকাশিত কথাটুকু। 


বহু সময় কেটে গেছে। জগন্নাথ জেঠু গত হয়েছেন নেই নেই করে বছর পনেরো হয়ে গেল। ঠাকুমা তারও আগে। ঠিক কত আগে সে আর মনে নেই। 

শুনেছি, দথু পিসিমার ছেলেপুলেদের সঙ্গে পড়ে থাকা ভিটেমাটির বন্দোবস্ত নিয়ে কোন্ এক প্রোমোটারের নাকি কথাবার্তা চলছে। অবশিষ্ট আইনি জটিলতা মিটে গেলেই কাজে হাত দেবে ওরা। 

ভুলে যাওয়ার পৃথিবীতে হয়তো আরো কিছুকাল রয়ে যাবে বিবর্ণপ্রায় ফাটলধরা চিরনবীন সে দেওয়ালের গায়ে আঁকা ক্যাম্বিস বলের আজন্মলালিত ছাপগুলো।

বাবা আফশোস করে বলেন, ' এ ভিটের মূল্য ছোট চক্কোত্তি আর দেখে যেতে পারলেন না !' 


শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

ব্যক্তিজীবনে ইতিহাসের শিক্ষক। গল্প লিখতে ভালোবাসেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কলমে বিগত শতাব্দীতে ফেলে আসা বাঙালি জীবনের কথা ভারি যত্নে ফুটে ওঠে।


Wednesday 20 July 2022

সংখ্যা দশ।। ২০জুলাই ২০২২।।মায়াপুকুর।।অনিন্দিতা মণ্ডল

মায়াপুকুর 

অনিন্দিতা মণ্ডল

পুকুরটা দিন দিন বড় হয়ে যাচ্ছে। মুকুন্দ ভেবে পায় না কি করে এমনটা হয়। যত দিন যাচ্ছে পুকুরটা চার পাঁচ বিঘৎ করে চারদিকে বেড়েই চলেছে। আগে ঘাটের ছ’টা সিঁড়ি দেখা যেত। ওপরে বাসনকোসন রেখে মা পিসিমারা দিব্যি পা ঘষত, মাথায় মাটি দিত। এখন মাত্র দুখানা সিঁড়ি জেগে থাকে। কে জানে কেমন করে হয় ! চার চারটে সিঁড়ি এখন জলের তলায়। দুপুরে চান করতে আজকাল ভয় হয়। পা পিছলে পড়লে কি হবে ? যদিও ময়না মুখ বেঁকিয়ে বলে—মরণ ! সাঁতার জানলে আবার মানষে ডোবে নাকি ? কিন্তু মুকুন্দর ভয় হয়। সাঁতার জানলেই বা। বিপদে পড়লে বুদ্ধি নাশ হয়। ও কি জানে ? কর্ণ মহারথী। তারই কিনা রথের চাকা বসে গেল ! বিপদে বুদ্ধিনাশ। সে কি আর রথ চালাতে জানত না ? অকারণে গর্তে ফেলবে কেন চাকা ? সেরকম মুকুন্দ জানলে কি হবে, গর্তে চাকা পড়ার মত আঘাটায় আটকালে কোন সমুন্দির পুত তাকে বাঁচাবে ? ময়নাটার বড্ড সবজান্তা ভাব হয়েছে। ছেলেপুলে বড় হয়েছে, মনে করেছে সব জেনে ফেলেছে। চন্দ্র সুজ্যি কেন ওঠে সেও বোধ হয় জানে। মুকুন্দ বেশি কথা বলে না তাই। ময়নাকে কিছু বললে ছেলেমেয়ের গোঁসা হয়। মা বলে সংসার মাথায় করে রেখেছে। কেন তাকে আকথা কুকথা বলা ?  


চোপর দুপুরে পুকুর ধারের সুপুরি গাছগুলোর তলায় ঝোপ সরিয়ে পাকা সুপুরি কুড়িয়ে তুলছিল মুকুন্দ। ময়না গাছ জমা দেয়। কিন্তু গাছের গোড়ায় পড়ে থাকা সুপুরি সে কুড়োতে পারে। হক আছে। ওই সুপুরি কি জলে ধপ করে পড়ে যাওয়া পাকা তাল লগা দিয়ে টেনে এনে মুকুন্দ তুলে নেয়। ওই কটা ফল বেচে আর কি হয় ? তবু যা হোক বিড়ির পয়সা জুটে যায়। কিন্তু ময়না তাড়া দেয়। তাড়াতাড়ি চান সেরে উঠতে হয়। ভাত বেড়ে মুখের সামনে দেবে ময়না। আবার মুখ ঝামটাও দেবে। মুকুন্দ ওই গলা শুনলে একবার জ্বলন্ত চোখে ঘরের দিকে চায়। তক্ক করতে বয়েই গেছে।


কিন্তু আজ খুব ভাবনা হচ্ছে। গত রাতে ছেলে প্রবোধ একবার শুনিয়েছে। ভিটেমাটি জুড়ে বসে আছ, বুঝতেও চাও না এরপর কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। মুকুন্দ বুঝতে পারে। এই একটা জায়গায় ছেলেমেয়ে দুর্বল। যতক্ষণ মুকুন্দ রাজি না হবে ততক্ষণ রেহাই পাবে না তারা। মুকুন্দ ছোট বালতি করে জল তুলে সিঁড়িতে বসে চান করে নেয়। তারপর খালি বালতিতে ফলপাকুড় গুলো নিয়ে গামছা চাপা দিয়ে উঠোনে ঢোকে।


দুপুরের খাওয়া হলে ময়না জম্পেশ ঘুম দেয়। কিন্তু মুকুন্দর দিনেরাতে ঘুম নেই। দুটো চিন্তা খেয়ে ফেলছে তাকে। এক, পুকুরটা কি শেষে ভিটে জমি সব খেয়ে ফেলবে? দুই, এ পাড়ার অন্যান্য পুকুরগুলো কিন্তু বুঁজে যাচ্ছে ক্রমশ। কিভাবে এরকম ঘটনা ঘটছে সেটা মুকুন্দর মাথায় ঢুকছে না। ওর পুকুরটা এরকম হল কি করে ? জল বেড়েই চলেছে!


সন্ধ্যের ঝোঁকে মুকুন্দ ফলগুলো গামছায় বেঁধে কেষ্টর কাছে গেল। কেষ্ট দোকানে বসেছিল। একাই। কেউ কোথাও নেই। এখন কেষ্টর দোকানের সেই রমরমা নেই আর। ফ্যাক্টরিতে তালা লাগার পর থেকে বাবুদের আসাযাওয়া বন্ধ। পাড়ায় আর কটা লোক ? মুকুন্দ সুপুরি আর তাল কটা ঢেলে দিতে কেষ্ট বেজার মুখে বলল—আর আনিসনি এসব। সুপুরি তবু শুকিয়ে অদ্ধেক পাবো। তালগুলো তো ভিজে একশা। ওই ভ্যাদভ্যাদে তাল কে নেবে ? ও তুই ফিরিয়ে নে। কেষ্টর মুখের দিকে চেয়ে মুকুন্দর মায়া হয়।


বলে, আচ্ছা, সে ছাড়। তুই তাল এমনিই নে। পয়সা দিতে হবে না। কিন্তু ক’দিন হল একটা গোল বেধেছে।


--কি গোল ?


--ময়রাপাড়ার পুকুর বুঁজে গেছে শুনেছিস?


--সে তো চোখের সামনেই দেখলাম।


--দেখলি কিরকম ?


--তুই বড় ন্যাকা, মুকুন্দ। পুকুর কি ওমনি বোঁজে রে ? বোঁজানো হয়।


--কে করে এমন ?


--লোক আছে। সে জেনে তুই কি করবি ?


মুকুন্দ ভাবে। বলা ঠিক হবে ? অবিশ্যি কেষ্ট তার ন্যাংটা বেলার বন্ধু। কিছুই অজানা নেই তার। শেষে বলেই ফেলল—আমাদের পুকুরটা কেমন বেড়েই চলেছে জানিস।


       কেষ্ট চোখ ছোট করে তাকায়। --তুই কি পুকুর বুঁজিয়ে ফেলতে চাস নাকি ? হারু মুকুজ্জের বিধবা বউটা রে, ওর সঙ্গে দারুণ পীরিত আছে ওই মদন দত্তর। ওই সব জমিজমা কিনে ফেলছে তড়িঘড়ি। পুকুর টুকুর সব। বলিস তো খোঁজ নিতে পারি। মুকুজ্জের বউটা আসে তো আমার দোকানে। কথা বলব ?


       নিমেষে মুকুন্দ নেমে পড়ে দাওয়া থেকে। কেষ্ট এমন বদলে গেছে ? সে পুকুর বেচবে কে বলল ? পুকুর হঠাৎ যদি ভিটে খেয়ে ফেলে সেই ভয়ে ও কথাটা পেড়েছিল। কিন্তু মুকুন্দ কেষ্টর চোখে স্পষ্ট লোভ দেখতে পেল। ছেলেবেলার বন্ধু। বড্ড বুকে লাগল তার। ময়না মুখ ঝামটা দিলে, বা ছেলেপিলে কুকথা বললেও এতটা লাগে না।


     এক পা এক পা করে মুকুন্দ পিছু হটে। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কেষ্টকে বলে, কাউরে বলবি নি বলে রাখলাম। এই শেষ কথা।


       কেষ্ট সে কথা শোনে কিনা বুঝতে পারে না মুকুন্দ। পথে নেমে পড়ে।


       সেদিন রাতে ময়না ভারি যত্ন করে খাবার দেয়। কাঠি বাটার ঝাল দিয়ে গরম ভাত। মুকুন্দ ওর মুখের দিকে চাইলে ময়না হাসল—সারাটা দিন পুকুর আর এঁদো ঝোপ নিয়ে পড়ে থাকো। হাতে পায়ে এই জলে হাজা হবে বলে রাখলাম। তা,পুকুরের মাছ কি চোখে পড়ে না ?


       মুকুন্দ খেতে খেতে মুখ তুলে চাইল। টাটকা মাছের সোয়াদ মুখে লেগে আছে। --মাছ পেলি কমনে ? ময়না গম্ভীর মুখে বলল—গামছায় তুলেছি। নিজেদের পুকুরের মাছ। খাব না নাকি ?


       --তুই একা তুললি ? নাকি আর কেউ ছিল ?


       --কথার ছিরি দেখ না! কে থাকবে শুনি ?


       --সাঁঝের বেলায় একা পুকুরে গেলি ? মাছ ধরলি ? বিশ্বেস হয় ?


       --কেন হয় না শুনি ? আমার কি কম দিন হল এ ঠাঁই ?


মুকুন্দ ভাত কটা খেয়ে উঠে পড়ল। দাওয়ার এক প্রান্তে কাঁঠাল কাঠের ছোট চৌকিটা তার রাতের আশ্রয়। দালান থেকে পুকুর ও চারপাশ স্পষ্ট। রাতের আঁধারেও সে দেখতে পায়। দালানের ওধারে ঘরে তখন ময়না ছেলেমেয়ে নিয়ে খেতে বসেছে। ছেলের গলাটা কেমন যেন জড়ানো নয় ? মদ খায় নাকি ও ? মেয়ের গলায় তেজ খুব। ময়না বলছে—বাপকে এই বেলা বল। অনেক কটা টাকা দেবে। ফ্ল্যাট দেবে দুটো। দুর্দশা একেবারে ঘুচে যাবে। ছেলের গলা—ক টাকা দেবে বলেছে কিছু ? –তা ধর না কেন কাঠা পিছু পাঁচ লাখ। মেয়ের গলা তেজালো—পুকুরেই তো খেয়েছে ক কাঠা, তার কি হবে ? ময়নার সহাস্য উত্তর—ও নিয়ে ভাবিসনি। পুকুর জমি এক দর।


       তারপর তিনজনে কত জল্পনা কল্পনা। ছেলের টাকার ভাগ বেশি চাই। মেয়ে না হয় বড় ফ্ল্যাট নেবে। আর ময়না ? তার কি আর অভাব রাখবে মদন দত্ত ? মুকুজ্জে বউ কেমন আছে সে কি সকলে চেয়ে দেখছে না ?


       তাহলে কথাটা পাড়বে কে ? ছেলের সেই জড়ানো গলা—এখুনি বলছি। কি মনে করেছে কি ? বাপের ভিটে বলে আমাদের হক নেই নাকি ? বুড়ো সই দেবেই। নইলে কুরুক্ষেত্তর হবে। বাপ বলে মানব না, এই বলে দিলাম। ময়নার আদুরে গলা শোনা গেল—যাক গে একটা রাত। একটু খেয়ে শুয়েছে। সকাল হলে বলিস খন। মেয়ের গলাও শুনতে পায় মুকুন্দ—সেই ভালো। ছাইপাঁশ গিলে আর বাবাকে ধমকাতে যাস না।


       ওঃ ! তাহলে তো পুকুর তার ভিটে গিলেই ফেলেছে ? মুকুন্দ মনে মনে হিসেব কষে। বিঘে তিনেক জমি ছিল। পাড় খেয়ে খেয়ে পুকুরটাই বিঘে দুই হয়ে গিয়েছে। এক বিঘে বাস্তু আছে। সে রাজমিস্তিরির কাজ করে এসেছে যতদিন গতর ছিল। এখন আর পারে না। ছেলে কিস্যু করে না। পারঘাটে বসে জুয়ো খেলে, মদ গেলে। মেয়েটা একটা নার্সিং হোমে আয়ার কাজ করে। মুকুন্দ যেহেতু জানে তাই আজকাল মুকুন্দর ডাক পড়ে পানা পরিষ্কার করতে। না না ভুল। কিছুকাল আগেও পানাপুকুরের জলে নেমে মুকুন্দ পানা তুলত। এখন আর ডাক আসছে না। সব জমি এখন ডাঙা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।


       গভীর আঁধারে তলিয়ে যেতে যেতে মুকুন্দ ভাবে, এই তার আজন্মর ভিটে। ওই পুকুর। ওতেই তো সে তার মা ঠাকুমার গন্ধ পায়। যেসব সিঁড়িগুলো ডুবে গেছে ওগুলোই তো মা, পিসিমা, ঠাকুমা, এরা। এতদিন অন্যর পুকুরে নেমে পানা টানলেও নিজেদের পুকুরে নামতে তার ভয় হত। মা যদি ডাকে ? সেও তো একটা ডুবে যাওয়া সিঁড়ি হয়ে যাবে তবে !


       ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে ময়না চায়ের কাপটা নিয়ে দালানে আসে। গজগজ করে—এমন বাদলায় ঘরে শোবে না কিছুতে। বদ লোক। কিন্তু চৌকির কাছে এসে ওর কথা থেমে যায়। উঃ ! কি জ্বালাতন ! এত ভোরে কোথায় গেল লোকটা ?


       ময়না হাঁক দেয়—কই শুনছ ? সাড়া নেই। অগত্যা দালান থেকে নেমে উঠোন। তারপর উঠোন থেকে নেমে পুকুরপাড়। ময়না চোখ মেলে খুঁজতে থাকে। হাঁক দেয়—কোথায় গেলে তুমি ? গলাটা ভেঙে আসে। সাড়া পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত কাপটা সমেত ধপ করে বসে পড়ে পুকুরপাড়ের সিঁড়িতে। আর ঠিক তখনই ওর মনে হয়, দুটো সিঁড়ির একটা ডুবে গেছে। সে শেষ সিঁড়িতে বসে আছে। জলের দিকে চেয়ে হাত বাড়িয়ে সে ডুবে যাওয়া সিঁড়িটা ছুঁতে চায়। নীচে আলোছায়ায় অসংখ্য মুখ ভাসে। তার কম বয়সের সব আপন মুখ। মুকুন্দর মুখটাও কি সুন্দর না ? 


অনিন্দিতা মণ্ডল

 গল্প লিখতে ভালোবাসেন। ফ্যান্টাসি জঁরের লেখা পছন্দ। প্রথম লেখা একালের রক্তকরবী পত্রিকায়। ছোট গল্প ও প্রবন্ধ যুগশঙ্খ জাগ্রত বিবেক মাতৃশক্তি ও সাহিত্য সংবাদ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ
 ১ রাজোচিত, প্রকাশক ঋতবাক। ঐতিহাসিক গল্পগুচ্ছ। 
২ লঙ্কাধীশ রাবণ, প্রকাশক খোয়াবনামা। উপন্যাস।
৩ সখী সংবাদ, প্রকাশক ঋতবাক। উপন্যাসিকা সংকলন। 
মাতৃশক্তিতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত 'অমিয়কায়' প্রকাশের অপেক্ষায়।



Wednesday 13 July 2022

সংখ্যা নয়।। ১৩জুলাই ২০২২।।পক্ষাঘাত।।তন্ময় সরকার

পক্ষাঘাত 

তন্ময় সরকার

এখন কত রাত ? দেওয়ালের ঘড়িটা কবে সাতটা পঁচিশ বেজে বন্ধ হয়ে রয়েছে। ব্যাটারি বদলানো হয়নি। এলইডি বাল্বের আলো অসময়ে ঘুম ভাঙা চোখে নুন ছেটায়। জ্বালা ধরে ভীষণ। মাথাটা পাথরের মতো ভারী আর বিষের মতো ব্যথা। ঘামে ভিজে গিয়েছে গায়ের সাদা গেঞ্জি। তাতে রক্তের দাগ পুঁটির আঁকার খাতার পৃষ্ঠার মতো, ঘাম চুঁইয়ে গেঞ্জির সুতো বেয়ে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছে।

খাটের এক কোনায় তেরচা হয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে পুঁটি। কেন ? ওওও, পুঁটুর তো খুব জ্বর। এলইডি বাল্বের নীচেই শো-কেসটা দাঁড়িয়ে আছে, দেওয়াল ঘেঁষে। গত বছর পুজোর আগে প্লাস্টিকের খেলনা সেটিং-এর কাজ করে ওটা কিনেছিল রিম্পি। কিন্তু ওটার কাচগুলো সব ভাঙা কেন ? ভাঙা কাচ ছড়িয়ে আছে মাটির মেঝেতে। ওওও, মনে পড়েছে।


মেঝেতে লুটিয়ে আছে রিম্পি। গোঙাচ্ছে। রক্তের বালিশে মাথা। খয়েরি রঙের নাইটি রক্তে ভিজে কালো হয়ে গিয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে বাঁদিকের গাল বেয়ে কানের কোটরে জমা হয়েছে। শুকনো রক্তের দাগে মনে হচ্ছে আগের কালের মেয়েদের মতো সে নোলক পরেছে। রিম্পি কিছু বলার চেষ্টা করছে। বলতে পারছে না। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে।

রিম্পির কাছে যেতে হবে। কিন্তু সারা শরীর লোহার মতো ভারী। মাথার মধ্যে কেউ হাতুড়ির ঘা মারছে। চুল থেকে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। ঝিম আসছে চোখে...

হাবড়া এক নম্বর রেল প্লাটফর্মের পিছন দিয়ে যে সরু ঢালাই রাস্তাটা চলে গিয়েছে স্টেশন রোডের দিকে, তার বাঁদিকে বস্তির ঘরেই ভুতোর বাবার চোলাইয়ের ব্যবসা। বাবার ব্যবসায় ভুতোকে সাহায্য করতে হয়, বিশেষত এই বিকেলবেলা। বাবা এখন নিজেই চুল্লু খেয়ে বেসামাল। মাঝে মাঝে শুধু চিৎকার করে মাকে গালাগাল দিচ্ছে। কাস্টোমারের প্রেসারও শুরু হয় এই বিকেল থেকে। কিন্তু আজ ভুতো ব্যবসা দেখতে পারবে না। আজ তাকে যেতে হবে মছলন্দপুর। মাঝে মাত্র একটা স্টেশন। দশ মিনিটে পৌঁছে যাবে। রিম্পি অপেক্ষা করবে। মাকে অনুরোধ করল, “আজ তুমি একটু সামলে নাও।”

মা খিঁচিয়ে উঠল, “ও পাপের ব্যবসা আমি দেখতি পারব না। শালা শুয়োরের বাচ্চা আমারে রাত দিন খিস্তি দেচ্ছে। ওর ব্যবসা আমি দেখতি যাব ক্যান ? ওরডা আমি খাই না পরি ? আর তুই কনে যাচ্ছিস ? পেরেম মারাতি যাচ্ছিস, তাই না ? ভাবতিছিস মা কিছু বুজদি পারে না ? ওই পেরেম-পিরিতি মারাও, কাজ করি খাতি হবে না !”


কথা বাড়ায় না ভুতো। রিম্পি অপেক্ষা করছে। দেরি হয়ে গিয়েছে।

মছলন্দপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে ডানদিকে কয়েকটা সাইকেল গ্যারেজ। তার পরের বস্তিটাই হল রিম্পিদের বস্তি। রিম্পির বাবা সুইপার। দুটো সিনেমা হল আর তিনটে স্কুলে সে সুইপারি করে। মানুষ খুব ভাল। কিন্তু হারামি হল রিম্পির দাদা। রিম্পিদের পাড়ায় গেলে নাকি ঠ্যাঙ ভাঙবে। ‘মাতালের বাচ্চা মাতাল ভুতো’র সঙ্গে নাকি ওর বোনের বিয়ে দেবে না। না, ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ঠ্যাঙ ভাঙাভাঙি হলে হবে।

কিন্তু আজ এসব ভাবতে ভাল লাগছে না। কথা মতো জ্যোতি সিনেমার সামনে এসে দাঁড়ায় ভুতো। একটু পরে রিম্পি আসে। ওরা হাঁটতে শুরু করে তিনআমতলার দিকে।

রিম্পির গা থেকে বিদেশি ফুলের গন্ধ আসছে। গত পুজোয় ভুতো গিফট দিয়েছিল এই সেন্টটা। রিম্পির লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ঝিলিক দেয়। বাঁকা চোখে তাকায় ভুতোর দিকে।

বাজারটা কাটিয়ে রিম্পি ভুতোর হাত ধরে। গায়ের মধ্যে শিরশির করে ওঠে ভুতোর। অনেকক্ষণ ধরে হাত ধরে হাঁটে ওরা। কেউ কোনও কথা বলে না। রিম্পিদের বস্তির দুটো ছেলে দেখে ফেলেছে। দেখুকগে। পিছনে গিয়ে একজন টোন কাটে, হাবড়া থেকে এসে মছলন্দপুরের মাল তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ভুতোর। পিছন ফেরে। হাত টেনে ধরে রিম্পি ফিসফিস করে, “ছেড়ে দাও !”

অন্ধকার হয়ে আসে। একটা গলির মধ্যে ঢুকে যায় দু’জনে। অন্ধকার সেখানে আরও বেশি কালো। রিম্পি এদিক-তাকিয়ে নেয়। না, কেউ দেখছে না। নিশ্চিন্ত হয়ে সে ভুতোর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ভুতো আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কবে আমাদের বিয়ে হবে ?”

রিম্পি উত্তর করে, “যেদিন তুমি বলবে।”

রিম্পির ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে আসে ভুতো। চুমু খায়। রিম্পির হাতে বাসন মাজা সাবানের গন্ধ। ভুতো বলে, “আমি তোমাকে আর লোকের বাড়ি বাসন মাজতে দেব না।”

রিম্পি কোনও কথা বলে না। ভুতোর চুলগুলো আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দেয়।...

তন্দ্রা কেটে যায় আবার। রিম্পি কি জল চাইছে গোঙিয়ে গোঙিয়ে ? নীচে নামতে হবে। কিন্তু শক্তি কোথায় ! নামার চেষ্টা করে ভুতো। দড়াম করে সে খাট থেকে মেঝেতে পড়ে যায়।

জল দিতে হবে রিম্পিকে। কিন্তু জল কোথায় ? একবার ওঠার চেষ্টা করে ভুতো। রিম্পি সমেত মেঝেটা দুলছে। এক-একটা হাতুড়ির ঘায়ে মাথা যেন ঝুঁকে যাচ্ছে। মাথাটা পাথরের মতো ভারী আর বিষের মতো ব্যথা। মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে উঠছে যন্ত্রণা।

রিম্পির কষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। লচাকে ডাকতে হবে। ও পারবে রিম্পিকে নিয়ে যেতে। লচাকে ডাকে ভুতো, “লচা... লচা...”

নিজের গলা নিজেই শোনা যায় না। রিম্পির গলার কাছে শিরাটা দপদপ করছে। আবার জল চাইছে। জল কোথায় ? নেই ? মাথাটা মাটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে নাকি ! না, নিজেকে সোজা রাখতে হবে। আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ভুতো। পড়ে যায়। রিম্পির বুকের পরে মাথাটা পড়ে।

ধুক্ ধুক্ ! রিম্পির বুকের শব্দের তালে তাল মেলায় মাথা-যন্ত্রণার দপ্‌ দপ্‌...

সে সময়টা খারাপ ছিল। পুঁটি তখন রিম্পির পেটে। বাবা নেই। মারা গিয়েছে তিন মাস। হঠাৎ একদিন থানার বড়বাবু দলবল নিয়ে এসে ধরে নিয়ে গেল ভুতোকে। অবাক ব্যাপার ! মাসিক মাসোয়ারা দিতে বাকি নেই। তাও! থানার খুপরিতে ঢুকে দেখল, সে একা নয়, বস্তির আর যারা ব্যবসা করে তারাও আছে।

আর ঠেক রাখা চলবে না। অনেক অনুরোধেও কাজ হল না। বড়বাবু সাফ জানালেন, তার কিছু করার নেই, উপরের অর্ডার। পাশে রাগে ভোম হয়ে বসে ছিল শিবু। গজগজ করল, “বুঝিস না ? আমাদের ব্যবসা করলে বড় বড় বারের কাস্টোমার কমে যাবে !”

হাবড়ায় ইতিমধ্যে পাঁচ পাঁচটা বার হয়েছে।

জরিমানা দিয়ে বারাসাত কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে ভুতোরা ফিরল পরের দিন। অনেকে তার পরও লুকিয়ে ব্যবসা রেখে দিল। কিন্তু ভুতো চলে গেল নাসিকে। আঙুরের ব্যবসার লেবারের কাজে। বছরে অফ সিজিনে একবার বাড়ি আসত। অসুবিধে কিছু ছিল না, শুধু বিদেশবিভুঁইয়ে কষ্ট হত রিম্পি আর পুঁটির জন্যে। তাও মা ছিল ওদের সঙ্গে, তাই ভরসা।

একদিন মা-ও মরল। ফিরে আসতে হল ভুতোকে। কিন্তু খাবে কী ? রিম্পি লোকের বাড়ি কাজ করে কোনওমতে তিনটে পেট চালায়। ভুতো একেবারে কিছু করে না তা নয়। এদিক-সেদিক মাঝে-মাঝে লেবারের কাজ করে। কিন্তু রোজ সন্ধের চুল্লুর খরচটাই তো অনেক।

ভুতো রোজ রাতে শিবুর ঠেক থেকে ঘরে ফেরে। রিম্পি রেগে গালাগালি দেয়। ভুতোর মাথা গরম হয়ে যায়। খুবই গরম হয়ে যায়। তাই প্রায় রোজ রাতে ঝামেলা বাধে রিম্পির সঙ্গে। মা-বাবার ঝগড়া দেখে পুঁটি কাঁদে।

সকালে ভুতোর খুব মায়া হয় রিম্পির জন্যে। পুঁটি ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাড়ায় বেরিয়ে যায়। রিম্পি তাড়াহুড়ো করে ঘরের কাজ সারে। সাত সাতটা বাড়িতে কাজে যেতে হবে তাকে। মশারির মধ্যে থেকে ভুতো ডাকে, “রিম্পি !”

রিম্পি খাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। ভুতোর মুখটা সে দেখে নেয়। তার পর মুখ বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্য করে, “উঁহ ! সকাল হলে উনার যত নঙ্গ !”

“আয় না !”

“ধ্যাৎ ! আমার অনেক কাজ। তাছাড়া পুঁটি চলে আসবে এক্ষুণি। তখন ?”

রিম্পি চলে যায়।

খুব ভাল মেয়ে রিম্পি। খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে রিম্পিকে।

রিম্পি এত টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে কেন ? বুকটা উঁচু হচ্ছে খুব, আর নেমে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর ? আঙুল দিয়ে রিম্পির গলার কাছে শিরার দপদপানিটা ছুঁয়ে দেখে ভুতো। খুব বেশি দপদপ করছে নাকি ? সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। রিম্পিকে জল খাওয়াতে হবে। লচাকে ডাকতে হবে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে রিম্পিকে। কিন্তু কীভাবে ? মাথাটা পাথরের মতো ভারী আর বিষের মতো ব্যথা। হাতুড়ির ঘা পড়ছে আর যন্ত্রণার টনটনানি বেড়ে যাচ্ছে। গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না। সোজা হওয়া যাচ্ছে না কিছুতেই। মাথাটা ধুকছে। চোখ বুজে আসছে...

এভাবে আর না। জয়গাছি সুপার মার্কেটের গোপাল পালের সঙ্গে পাকাপাকি কথা হয়েছে। ফলের লরি লোড করার কাজ করবে ভুতো।

এক সপ্তাহ হল রাগ করে মছলন্দপুর চলে গিয়েছে রিম্পি। খবর পেয়েছে ভুতো, পুঁটির খুব জ্বর। ভয় হয়। ডাক্তার সন্দেহ করেছেন ডেঙ্গি। এখন চারিদিকে ডেঙ্গিজ্বরে মারা যাচ্ছে অনেকে। রক্তের টেস্ট দিয়েছেন ডাক্তার। কিন্তু সে অনেক টাকার ব্যাপার।

আজ সকালবেলা মছলন্দপুর গিয়ে পুঁটি আর রিম্পিকে নিয়ে এসেছে ভুতো। রিম্পির খুব অভিমান। আসতে চায়নি। আবার ভেবেছে, যাবে কোথায় ?

অনেক বুঝিয়েছে ভুতো। প্রতিজ্ঞা করেছে, রিম্পির গায়ে সে আর হাত দেবে না কোনওদিন। আড়ালে নিয়ে গিয়ে অনেকদিন পর সে রিম্পিকে চুমু খেয়েছে। রিম্পি ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর বুকের উপরে মিথ্যে মিথ্যে ঘুসি মারছিল।

এবার ভুতো পাল্টে যাবে— আশা জাগে রিম্পির মনে। নাকি আবার চুল্লু খেয়ে ঝামেলা করবে ! আশঙ্কা হয়। আশা আর আশঙ্কায় দুলতে-দুলতে অসুস্থ পুঁটিকে কোলে নিয়ে ভুতোর সঙ্গে হাবড়া চলে এসেছে রিম্পি।

রিম্পির একটা ভেলভেটের ব্যাগ আছে। সোনার দোকানের ব্যাগ। রিম্পির মা পুঁটিকে এক জোড়া রুপোর তোড়া গড়ে দিয়েছিল। তোড়া আর নেই। ব্যাগটা আছে। সেই ব্যাগে পুঁটির রক্ত পরীক্ষার জন্যে সাড়ে তিনশো টাকা রেখে ভুতো গিয়েছিল জয়গাছি সুপার মার্কেটে।

সন্ধে-সন্ধে ফিরে এল ভুতো। রিম্পি জিজ্ঞেস করল, “কাজ হয়েছে আজ ?”

ভুতো জবাব দেয় না। শালা হারামি গোপাল পাল ! কথা খেলাপ করল। কাজটা দেবে বলেও দিল না। অন্য লোককে কাজে লাগিয়ে দিল। শয়তানটাকে বাগে পেলে আচ্ছা মতো ভোগাতে হবে।

রাগে সারা শরীর জ্বালা করে। দাঁতের মধ্যে শিরশির করে। কপাল্টা টিপটিপ করে ব্যথা করে। গায়ে কাঁটা দেয়। ভুতো জানে এই রোগের ওষুধ কী। রিম্পি পাশের ঘুপচি রান্নাঘরে চাল চড়িয়েছে হাড়িতে। বিছানায় পুঁটি জ্বরে বেহুঁশ। ভেলভেটের ব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে নিয়ে শিবুর ঠেকের দিকে চলে যায় ভুতো।

অনেক খেয়ে ফেলেছে আজ। অনেক। রাত এগারোটা। রিম্পি জোরে ধাক্কা দেয়, “মাতালের বাচ্চা মাতাল ! মেয়ের চিকিৎসার টাকায় মাল গিলতে লজ্জা করে না তোর ? শালা শুয়োর ! বউ মেয়েকে খাওয়ানোর মুরোদ নেই, শুধু মাল গিলতে পারিস !”

উন্মাদ হয়ে যায় ভুতো, এত বড় কথা !

“কত সাহস তোর মাগি ! আমার পয়সায় আমি মাল খাই। তোর কী ? দেখাচ্ছি, দাঁড়া !”

চুলের মুঠি ধরে এক আছাড়ে রিম্পিকে ঘর থেকে বাইরে ফেলে ভুতো। দরজার হাঁকটা তুলে নেয়। এক বাড়ি মারে শোকেসের কাচে। ঝুরঝুর করে কাচ ভেঙে পড়ে মেঝেতে। শব্দ শুনে পাড়ার লোক ছুটে আসে। রিম্পি দৌড়ে পাশের বুল্টিদের ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। সেখান থেকে রিম্পিকে হিঁচড়ে টেনে আনে ভুতো। বুল্টি বাধা দেয়। চিৎকার করে ভুতো, “এই খানকি মাগি, সাধন যখন তোরে ক্যালায়, আমরা আসি ? তুই আমাদের মধ্যে ঢুকছিস কেন, শালি ? ছাড় ওকে।”

“বাজে কথা বলবি না, ভুতো, বলে দিলাম।”

জবাব দিয়ে বুল্টি ঘরে ঢুকে যায়। রিম্পিকে টানতে-টানতে আবার ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে ভুতো। লচা ছুটে আসে, “বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু, ভুতো !”

লচার বুকে বাঁ-হাতের তালু দিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয় ভুতো। তার পর চটাস-চটাস করে নিজের বুক চাপড়ে বলে, “এই শালা, ও আমার বউ, আমার ! আমার বউকে আমি খাওয়াই। আমি মারব। তোর এত দরদ কেন ? আজ আমি ওকে মেরেই ফেলব। তার পর যদি জেলে যেতে হয় যাব। তুই ফোট্ !”

নিজের ঝুপড়ির টিনের ঝাপে দুটো ঘুসি মারে ভুতো। টিন তুবড়ে যায়। লচা আগুন চোখে তাকায়। লচার চোখের দিকে আঙুল উঁচিয়ে গর্জে ওঠে ভুতো, “তাকাচ্ছিস কী ? ফোট্ ! আজ আমার হাত থেকে শালার মাগিকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”

লচা চলে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে আগুন চোখে ভুতোর দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যায়।

মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হয়েছে রিম্পির। পৃথিবীর কোনও আইন, কোনও আদালতের ক্ষমতা নেই রিম্পিকে আজ বাঁচায়। ঘরের সামনের শেডের সাপোর্ট দেওয়া বাঁশ খুলে নেয় ভুতো। ভুতোর মতো লম্বা বাঁশ। ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দেয়। মেঝেতে ভয়ানক ভয়ার্ত চোখে মুণ্ডুকাটা মুরগির মতো ছটফটিয়ে কাঁপছে রিম্পি...

রিম্পির বুকটা আর কাঁপছে না। ভুতোর বুকটা কেঁপে ওঠে খুব জোরে ! গলার কাছে আঙুল দেয়। শিরাটার দপদপানিও থেমে গিয়েছে।

“মরে গেলি নাকি, রিম্পি ? মরিস না, প্লিজ মরিস না, ফিরে আয়। আয় না! তোকে খুব ভালবাসি। আর কোনওদিন মারব না তোকে। কোনওদিন না !”

রিম্পির বুকের কাছে কান চেপে ধরে ভুতো। কেঁপে উঠল কি একবার বুকটা ?

“ফিরে এলি, রিম্পি ? ফিরে এলি ?”

না। এ কাঁপুনি রিম্পির বুকের নয়। হর্ন দিয়ে পুরো বস্তিটাকে কাঁপিয়ে ফার্স্ট ট্রেন চলে গেল শিয়ালদার দিকে।

এলইডি বাল্বের বেয়াড়া আলো চোখে নুন ছেটায়। জ্বালা ধরে। চোখ বুজে রিম্পির বুকের পরে মাথা রাখে ভুতো। জ্বালা ধরা চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আর রিম্পির শুকিয়ে ওঠা রক্তে ভেজা নাইটি আবারও ভিজতে থাকে।

তন্ময় সরকার

বসবাস-- হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা। পেয়েছেন 'বহুস্বর অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি গল্প প্রতিযোগিতা-২০২০'-তে প্রথম পুরস্কার। আনন্দমেলা, সাপ্তাহিক বর্তমান, কিশোর ভারতী, আজকাল, বহুস্বর, দাঁড়াবার জায়গা, শতানীক, অবগুণ্ঠন, ইরাবতী, অপার বাংলা সহ আরও অনেক পত্রপত্রিকা ও ওয়েবজিনে ছোটগল্প ও অণুগল্প প্রকাশিত। 

Wednesday 6 July 2022

সংখ্যা আট।।৬জুলাই২০২২ ।।শ্রাবণ ঘন গহন মোহে ।। অমিতাভ দাস

 শ্রাবণ ঘন গহন মোহে 

অমিতাভ দাস

জয়ন্ত'র রাতে ঘুম আসে না। ঘুম না আসার নানা রকম কারণ আছে। জয়ন্ত আগে ছাত্র পড়াত। করোনার মতো অতিমারী আসার পর থেকে ছাত্র কমতে কমতে এখন শূন্য। সে কখনো ভাবেনি তার ছাত্র সংখ্যা শূন্যতে গিয়ে দাঁড়াবে। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা-পয়সা এতদিনে ফুরিয়েছে। ইন্সুরেন্সের প্রিমিয়াম আর জমা দিতে পারছে না। বাবা-মায়ের নিত্য অসুখ। 


    রাত হলেই দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা তার মাথায় এসে নামে। সে রোজ রাতে ভাবে আজ চোখ বুজে শান্ত চিত্তে ঘুমিয়ে পড়বে। 'এত ভেবে কী লাভ' ! সে ভাবে--'জিভ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি'। তবু বজ্জাত ঘুম তার চোখে আসে না। সারাদিন চিন্তা করতে করতে ভোর হয়ে যায়। পাখি ডাকে। খোলা জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢোকে। তখন তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে এলার্ম দিয়ে রাখে। মাত্র চার ঘন্টা ঘুমোবে। নটার সময় ঠিক উঠে যাবে এলার্মের শব্দে। অথচ রোজ এলার্ম বাজে, সে চোখ খুলে বিরক্ত হয়ে এলার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মা দু-তিনবার ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যায়। এভাবেই দিন যায়। জয়ন্ত কখনো বারোটা কখনো একটায় ঘুম থেকে ওঠে। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিজেই এককাপ চা বানিয়ে ফেসবুক নিয়ে বসে যায়। 'এই হয়েছে এক জ্বালা-- এই ফেসবুক'। রোজ ভাবে ' আজ সারাদিন ফেসবুক খুলব না' কিন্তু ঠিক খুলে ফেলে। ফেসবুকে ঢুকতেই নিউজ ফিডের নানা ছবি, খবর দেখতে দেখতে তিনটে বেজে যায়। মা বলেন, 'আমি কিন্তু খেতে দিতে পারব না, নিজে নিয়ে খেতে হবে। ' একথা শুনেই সে স্নানে যায়। মাত্র এক বালতি জলে সামান্য ডেটল ফেলে স্নান করে আসে। স্নান শেষে ঠাকুর ঘরে গিয়ে প্রার্থনা করে। কী সব মন্ত্রটন্ত্র বিড়বিড় করে পড়ে। নিজের জন্য সে কিছুই চায় না। বলে:' সবাই যেন ভালো থাকে। করোনা যেন কমে যায়। আমায় শ্রদ্ধা-ভক্তি দাও'। এইসব বলে-টলে সে একটা লাল জবা মা তারার পায়ে নিবেদন করে। 


    যা রান্না হয়। সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। সিদ্ধভাত বা ডালভাত সঙ্গে একটা ভাজা। অনেক দিন মাছ খায় না। মাংস অবিশ্যি আসে না ওদের বাড়িতে। বাবা-মা মাংস খান না। সপ্তাহে একদিন ডিম জুটে যায়। টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া জয়ন্ত'র বহুদিনের অভ্যেস।সে খবর দেখে। আজকাল খবর দেখতেও আর ভালো লাগে না। লকডাউন, ট্রেন বন্ধ, স্কুল বন্ধ, মানুষের অভাব, মানুষ রাত থেকে লাইন দিয়ে ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। এসব দুঃখের খবর জয়ন্তকে ছুঁয়ে থাকে সারাদিন। খুব কষ্ট হয়। রাগ হয় যখন শোনে কোন নায়িকা পুরোনো বরকে ছেড়ে নতুন কাকে বিয়ে করল, কোন নেতা পরকীয়া করে কালবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেল, কে আবার দল বদলে পুরোনো দলে ফিরল--এসব খুব নোংরা মনে হয়। ভয়ংকর বিরক্ত হয়।' দিন দিন সংবাদ মাধ্যমগুলো টি আর পি বাড়ানোর জন্য এসব দেখাচ্ছে! অথচ স্কুল বন্ধ, মানুষের কাজ নেই, এত অভাব, প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নেই--- এসব নিয়ে প্রচার নেই কেন ? কেন্দ্র দিচ্ছে রাজ্যকে দোষ, রাজ্য কেন্দ্রকে। কোথায় বাস করছি। দীর্ঘদিন এস এস সি পরীক্ষা হয় না। চাকরি নেই। নতুন কোনো কারখানা হচ্ছে না। পুরোনো কারখানা যাও ছিল তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব দিকে কারো কোনো হুঁস নেই কেন ? '


     জয়ন্ত শেষ এস এস সিতে বসেছিল ২০১১তে তারপর আর এস এস সি তো ঠিকঠাক হলোই না। তার বয়স বেড়ে গেল। চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছে। আর বসতেও পারবে না। তার এনার্জিও আর নেই। নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা প্রচুর নম্বর নিয়ে বসে আছে--চাকরি নেই। খুব অসহায় লাগে নিজেকে। কী করবে বাকি জীবন ? কীভাবে চলবে তার? 'এই তো সেদিন ডোমের চাকরির জন্য পি এইচ ডি করা ছেলেমেয়েরা নাকি এপ্লাই করেছে-- কাগজে লিখেছে। এতেই তো বোঝা যায় রাজ্যের অবস্থা। পরবর্তী প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? '


    এসব জয়ন্তর ভাবার কথা নয়। তবু ভাবে। বোকা বলেই হয়ত ভাবে।একটা সময় ছিল যখন জয়ন্তর কাছে ১০০/১৫০ ছেলেমেয়ে পড়ত। পুজোর পর আর শিক্ষক দিবসে সে ছাত্রছাত্রীদের ভালো-মন্দ খাওয়াত। আজ নিজেই ঠিক মতো খেতে পায় না। সময় মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়।


   জয়ন্ত বুঝতে পারে ওর ধনী বন্ধুরা ওকে এড়িয়ে চলে। স্কুল শিক্ষক, প্রফেসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার , আইটি সেক্টরের কর্মী বন্ধু ওর অনেক আছে। করোনার আগে সেইসব বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে সে পানশালাতে  যেত। পার্টিতে ডাকত ওরা। তখন জয়ন্তর পকেট ভর্তি টাকা ছিল। একটা বাইক ছিল। সুন্দরী প্রেমিকাও ছিল। গত দুবছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। গত মাসে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে। যেমনটা গল্পে বা সিনেমায় হয়। বেকার মানুষকে বিয়ে করল না মৃত্তিকা। করোনার মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল। হায়দ্রাবাদ সেটল হল। বর বড়ো চাকরি করে। ম্যাট্রিমনি সাইট থেকে পাত্র যোগার করেছে সে। এসবে জয়ন্ত খুব একটা দুঃখ পায়নি। কারণ দুঃখ পেতেও একটা অবকাশ দরকার। এত এত এত হতাশা আর দুঃখের মেঘ জমে আছে ওর ভেতর ঘরে যে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেল বলে শোক করার সুযোগ নেই। নিজের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ইচ্ছা শক্তিও কমছে। মৃত্তিকার বিয়ের রাতে শুয়ে শুয়ে ভেবেছে 'যাক ভালোই হল। চাপ নেই। একা হয়ে গেলাম। এই বেশ ভালো হল'। পরক্ষণেই জয়ন্তর আরেকটি সত্তা বলে উঠল,' জয়ন্ত তুমি ভীরু। পলায়নবাদী। হেরে যাওয়া একটা লোক। কাজ করো। খাটো। কিছু না পেলে জন খাটো যাও। অপদার্থ...'


        হঠাৎ যেন পৌরুষ জেগে ওঠে ওর। ভেতরে সেই সত্তার কাছে ধিক্কার পেয়ে সে ঠিক করে ' কাল সকালেই কিছু একটা করতে হবে। করতেই হবে। কোনো কাজ ছোট নয়।' সে ঠিক করে গ্রামের ভেতরে ফল নিয়ে বেচবে। অনেক দূরে চলে যাবে। কেউ চিনবে না। পরক্ষণেই মনে হয় গত উনিশ বছরে এত ছেলেমেয়েকে সে পড়িয়েছে যে কেউ না কেউ ঠিক-ই চিনে ফেলবে। বলবে 'টিউশন খুইয়ে স্যার এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফল বিক্রি করে। ছ্যা ছ্যা। না এ আমি পারব'। ওই যে স্যার শব্দের মোহ এখনো জয়ন্তকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।


    বাইকটা আর নেই। বিক্রি করে দিয়েছে। নিজেকে বোঝায় ' ভালোই হয়েছে। আজকাল তেলের যা দাম। তাছাড়া টিউশন নেই। গৃহবন্দী। ফালতু বাড়িতে বসিয়ে গাড়িটাকে নষ্ট করে কী হবে-- যা হয় ভালোর জন্য-ই হয়।'

--'তাই বলে দশ বছরের গাড়িটা বিক্রি করে দিলি!' আশ্চর্য হয় ওর মা। ' আর কখনো কিনতে পারবি ?'

--' পারব না তো। আর কিনে কী হবে! 'মৃত্তিকার কতো স্মৃতি ছিল। গাড়ির পেছনে মৃত্তিকাকে বসিয়ে জয়ন্ত উড়ে যেত। পেরিয়ে যেত কল্পনার সাত সমুদ্র তের নদী। মৃত্তিকা ওকে জাপটে ধরে থাকত।


    জয়ন্ত মৃদু হেসে মাকে বলে, 'মৃত্তিকাও নেই ওর স্মৃতিও নেই। এই বেশ ভালো হল জানো'...মা রান্নাঘরে চলে যান। আড়ালে চোখের জল মোছেন।


      সে সাইকেল চালিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। বয়স্ক ডাক্তারবাবু খুব মজার মানুষ। স্থানীয় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। হাতযশ আছে। জয়ন্তর সঙ্গে ভালো ভাব। বললেন, 'সমস্যা কী ?'

'ঘুম আসে না রাতে'। 

'আর ?'

'পেটের সমস্যা।' বলে চুপ থাকে জয়ন্ত।

'আর ?'

'হাতে-পায়ে জোর পাই না।'

'রাতে না ঘুমোলে পেট গরম হবে, হাতে পায়ে বল পাবেন না --এ আর নতুন কী ? বিয়ে করুন তো মাস্টারমশাই। একটা বিয়ে করা দরকার। সব সমস্যা কেটে যাবে'। বলে ফিচেল হাসি হাসেন।


    জয়ন্ত বলে, 'সব-ই বুঝি ডাক্তারবাবু। এই বেকারটিকে বিয়ে করবে কে ? আর বিয়ে করলেও খাওয়াবো কী !''


    তিনি বললেন,' সমস্যা গভীর। তবে বিয়ে করতে হবে। আরে মশাই এত ভাবছেন কেন, করোনা কী সারাজীবন থাকবে। শুনুন ঠাকুর বলেছেন:  চিনি জোগাবেন চিন্তামণি'।


রাতে শোয়ার পর এইসব ভাবতে থাকে সে। লকডাউনে বাইরেও খুব একটা যায় না। মাঝে মধ্যে বিকেলের পর ভূষণকাকার দোকানে গিয়ে বসে। এফ এমে ভূষণকাকা এখনো গান শোনে। মাঝে মাঝে তা জয়ন্তর বেশ ভালোই লাগে।


           এখনো কিছু জমানো টাকা আছে। তা দিয়ে সে নিজের হাত খরচ চালায়। হাত খরচ বলতে চা আর সিগারেট। সিগারেট দিনে দুটি। এখনো একটা রাজকীয় চাল বজায় রেখেছে। আগে দিনে এক প্যাকেট লাগত। 'করোনা আমার এই উপকারটা তাহলে করেছে।' মনে মনে হাসে। 


    ঘুম নেই চোখে। বাইরে বৃষ্টি পড়ে। দুদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। কম-বেশি নানা লয়ে। নানা ছন্দে।

           

অনন্ত কালের বৃষ্টি। অনন্তকালের শূন্যতায় বৃষ্টি পড়ে। বাইরে বৃষ্টি পড়ে অথচ ভিজে যায় জয়ন্ত'র বিছানা-বালিস-চাদর মায় এই নশ্বর শরীর। সে ঘরের ভিতর জল খোঁজে। কোথা থেকে এলো জল ? কীভাবে ভিজে গেল সব ? বাইরে 'শ্রাবণ ঘন গহন মোহে'...ভেতরে শ্রাবণ থাকে ? ছিল এতদিন ? শ্রাবণ তো একটা মাস। জয়ন্ত ভাবে, আমার কী...আমার ঘুম আসে না কেন ? আজ আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন ?...সে অন্ধকারে আলো জ্বালে। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ। হাওয়ায় ক্যালেন্ডারটা দোলে। মনে পড়ে 'আজ তো বাইশে শ্রাবণ। আজ তো তাঁর চলে যাওয়ার দিন। আমার ঈশ্বর এই দিনেই তো চলে গিয়েছেন। তাই তো চরাচর ভিজে যাচ্ছে শ্রাবণধারায়। '

 

 দক্ষিণের জানালাটা এখন খুলে দিয়েছে জয়ন্ত। আকাশটা মেঘে মেঘে ধূসর কালো। মেঘ ডাকছে এখন। জয়ন্ত বুকসেল্ফ থেকে গীতবিতানটা টেনে বার করে। এই বইতে মৃত্তিকার ছোঁয়া লেগে আছে। সে খুব ভালো গান গাইত। এই গানটায় এসে জয়ন্তর আঙুল আটকে গেল। লেখা আছে: ' যদি প্রেম দিলে না প্রাণে 

কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে...'


     ভোর হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। সঙ্গে নেমেছে বৃষ্টি। জয়ন্ত অনুভব করল বাইরের শ্রাবণ কখন যেন ভেতরেও চলে এসেছে আবার। তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে শ্রাবণ, তার নিজস্ব ধারায়। 


অমিতাভ দাস

অমিতাভ দাস মূলত কবি। তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি অণুগল্প , ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখেন। প্রকাশিত বই প্রায় ত্রিশটির বেশি । পেয়েছেন 'বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার, সুতরাং সাহিত্য সম্মান , কলম সাহিত্য সম্মান , কালদর্পন সাহিত্য সম্মান , টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার, অনিলা দেবী সাহিত্য পুরস্কার।

অবগুণ্ঠন সাহিত্য পত্রটির সম্পাদনা করে আসছেন ১৯৯৬ সাল থেকে । সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা লেখা প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...