Wednesday 21 September 2022

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর


নরকের প্রেমকাহিনী 

 তন্ময় ধর 

'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভিজাত্য নিয়ে মেয়ে প্রজ্ঞার দিকে তাকালেন মহারাজ ধরাধরেন্দ্র।

মা পাশ থেকে করুণ মুখে বললেন 'হ্যাঁ রে মা প্রজ্ঞা। আমার কথাটা শোন। তোর বাবা এমন রাশভারী নাম আর আভিজাত্য নিয়েও আমার জীবনটা নরক করে দিয়েছেন। আর এর নামই নরক। তোর জীবন নরক করে দেওয়ার জন্য যেন এক পা বাড়িয়েই আছে...'

'তুমি বুঝছো না মা। ও কুড়ি বছর বয়সেই এক রাতে কামাখ্যা মন্দির বানিয়ে ফেলেছে। গোটা ভারতবর্ষের ওই পুরুষতান্ত্রিক বৈদিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে মাতৃতান্ত্রিক তন্ত্রের লড়াইয়ে একমাত্র মুখ ও। শুধু এই প্রাগজ্যোতিষ নয়, সমগ্র পূর্বভূমিকেই ও একার হাতে রক্ষা করবে...'

'দ্যাখ মা, জনগণ এসব মন্দির, প্রকৃতি-পুরুষ, বেদ-তন্ত্রের দর্শন বোঝে না। তাদের কাজ চাই, পেটে ভাত চাই...'

'মা, ও কর্মেই বিশ্বাসী। বৈদিকদের শুষ্ক জ্ঞানকান্ডের কচকচানি থামাতে বিশাল এক কর্মকান্ডের পরিকল্পনা করেছে। গ্রামে-গ্রামে ক্ষুদ্র ও স্বনির্ভর কর্মযোজনা, সমবায় প্রকল্প, যৌথ খামার ইত্যাদি নিয়ে ব‍্যাপক ক্ষেত্রসমীক্ষা করে গবেষণা করছে ও...'

'বলিস কি রে, মা !'

'তবে আর বলছি কি ! মা, এই বয়সেই ও যা ত্রিকালদর্শী দৃষ্টি দেখাচ্ছে তাতে ওর কাজকর্ম সুদূর ভবিষ্যতে বৈপ্লবিক বলে পরিগণিত হবে। ভবিষ্যতের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাংখ‍্যদর্শন, সাম‍্যবাদ- সব কিছুর ভিত্তিভূমি তৈরি করছে ও...'

'সবই বুঝলুম। কিন্তু নামটা ? একে নরক, তায় অসুর! ও নাম নিয়ে বিড়ম্বনার একশেষ হবে। রাস্তাঘাটে বেরুলে যখন লোকে আমাকে বলবে 'ওই যে নরকাসুরের শ্বশুর যাচ্ছেন' তখন আমার সেটা শুনতে কতখানি খারাপ লাগবে তুমি বুঝছো না। আর শুনেছি সে ছেলের বংশপরিচয় নেই, নিজেকে ভৌম অর্থাৎ পৃথিবীর সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয়। তার সাথে তোমার বিয়ে দিলে আমাদের আভিজাত্যটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, একবার ভেবে দেখেছো ? তখন কি সম্মান বাঁচাতে ঐসব আর্থসামাজিক সাম্যবাদ আর গণতন্ত্রের গবেষণা ধুয়ে জল খাবে ?' আবার কমল মিত্রসুলভ স্বরে গর্জে উঠলেন ধরাধরেন্দ্র। 

'বাবা, তাহলে কি তুমি বলতে চাইছো যে, নাম আর আভিজাত্যই তোমার কাছে শেষ কথা ?'

'বলতে চাইছি নয়, সেটাই বলছি' এক চূড়ান্ত কঠোর গার্জেনের গর্জন শোনা গেল ধরাধরেন্দ্রর গলায়।

'মা, তোমারও কি একই বক্তব্য ?'

'না রে মা। তোর বাবা চিরকালই আমার বক্তব্যকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনাটাই নিজের কর্তব্য মনে করেছে। কিন্তু তাতে কি আর ভবিতব্য পালটায় ? তুই নরককে বল, তার সুকর্মে আমার সমর্থন আছে। সে এসে যুদ্ধ করে তোর বাবাকে পরাজিত করে তোকে হরণ করে নিয়ে যাক...'

'কি বলছো মা !! তাহলে আমার শাড়ি, গয়না, মেক-আপ, কনেযাত্রীদের সাজগোজ, নিমন্ত্রিতদের প্রীতিভোজ- এসবের কি হবে ? বিয়ে মানে কি শুধুই দু'টি প্রাণের মিলন ? বিয়ে মানে দু'টি প্রাণ এক হয়ে এক অনন্ত জীবনবিস্তারে কালপারাবার পার হয়ে চলা, লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তরে এক নিরন্তর প্রাপ্তির পূর্ণতা। জিয়াভরলির তীরে যখন নরকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, তখনই সে এই চিরমিলনের কথা বলেছিল। আমাদের অসীম অনন্ত অস্তিত্বের কথা বলেছিল। এই প্রাণমন্ডলের প্রতিটি স্পন্দনে, এই জ্যোতির্মন্ডলের প্রতিটি উদ্ভাসে, এই অন্তরীক্ষ-নক্ষত্র-নীহারিকার অপার ঐশ্বর্য্যবিস্তারে- সর্বত্র আমরা আছি…’

‘হুম। তার মানে নরক প্রথম দর্শনেই অনেক কাব্যি করে আমাদের কন্যার সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমটাই আগে খেয়েছে’ বজ্রগম্ভীর স্বরে ধরাধরেন্দ্র বললেন ‘প্রজ্ঞার মা, আমি না হয় রাজকার্যে ব্যস্ত থাকি। তুমি তো দেখতে পারো, তোমার মেয়ে ওইসব কল্পনাবিলাসী সুররিয়াল বায়রনিক হিরোদের সাথে মিশে অন্য নক্ষত্র-নীহারিকায় উড়ে বেড়াচ্ছে কিনা…’

‘বাবা, কথাটা সরাসরি আমাকে বলতে পারো। আমার পছন্দ-অপছন্দ, আমার চিন্তার স্বাধীনতা- এসব তোমার রাজকার্যের এক্তিয়ারে পড়ে না। আমি এই মুহূর্তে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত...'

'এমন করিস নে, মা। আমার কথাটা একটিবার শোন। মাথা গরম করে, বিবাদ করে কোন কাজ হয় না। তুই নরককে একবারের জন্য আলোচনার টেবিলে ডাক...'

'কার ভরসায় ডাকব, মা ? বাবার কথাবার্তার ধরন তো দেখছো !'

'আমি কথা বলব। কোর্টে এফিডেভিট করে যদি নামটা বদলানো যায়। আর হাইটটাও শুনেছি মাত্র পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। আজকাল নানারকম ওষুধ-টষুধ পাওয়া যায়। যদি তা খাইয়ে একটু বাড়ানোর চেষ্টা করা যায়...'

'মা, অ্যাম আই আ জোক টু ইয়্যু ?' চোখে জল এল প্রজ্ঞার 'যেভাবে তোমরা কথা বলেছো, তাতে এ প্রাসাদে আমার থাকার অর্থ হয় না। আপাতত আমি মামাবাড়ি চললাম। ওখান থেকেই নরকের কাছে যাব। তোমাদের সাথে হয়ত আর দেখা হবে না' বাবা-মাকে প্রণাম করে প্রজ্ঞা প্রাসাদ ত্যাগ করতে উদ‍্যত হল।

'অবুঝ হোস নে, মা। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিস না। আমরা তো আলোচনায় রাজি আছি...' প্রজ্ঞার মায়ের কথা থামিয়ে আবার গর্জন করলেন মহারাজ 'কেন আটকাচ্ছো মহারাণী ? রাজনন্দিনীকে একবার বাপের ছত্রছায়ার বাইরে বেরিয়ে কঠিন দুনিয়াটা দেখতে দাও না ! আর ওই কল্পনাবিলাসী, তান্ত্রিক সুরাপায়ী, প্রেতসঙ্গমকারী ওই নরকাসুর না কি যেন, ওটাকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসতে দাও। তারপর আমি বুঝিয়ে দেব কত ধানে কত চাল, আর কত চালে কত পাটিসাপটা'

'বাবা, আমি শুধু নামেই ধরাধরেন্দ্রনন্দিনী নই, আমি যুদ্ধকালে রণচণ্ডী। যুদ্ধ কিভাবে জিততে হবে, তা আমার জানা আছে। চললাম...'

আবার বাধা পড়ল। ঘরে যেন এক প্রবল বজ্র চমক। তড়িৎশিখার মত চমকে দিয়ে হাজির এক আগন্তুক। আর উপস্থিত হয়েই তার ঘোষণা ‘আমিই নরক। এভাবে বিনা নিমন্ত্রণে অজ্ঞাতসারে আপনাদের আলোচনার মাঝে উপস্থিত হওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কিন্তু আপনারা বোধহয় আমাকে মারতে চাইছিলেন। তার জন্য যুদ্ধের আয়োজন বা রাজকীয় আলোচনাসভার আয়োজন করে বিলম্বের কি প্রয়োজন? আমি একাই যুদ্ধে কয়েকশো সৈন্যের মোকাবিলা করতে সক্ষম। আলোচনাতেও কয়েকশো পন্ডিতকে একসাথে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম। হয় সৈন্য ডাকুন, পন্ডিতদের ডাকুন, বা নিজেরাই পরখ করুন। কিন্তু আমি চাই এখনই, এই মুহুর্তেই ব্যাপারটির নিষ্পত্তি হোক। হ্যাঁ, আমি মহারাজ ধরাধরেন্দ্রকে ধরাশায়ী করে তাঁর কন্যাকে হরণ করার জন্যই এখানে এসেছি। সফল না হয়ে আমি যাব না…’

‘কনফিডেন্স ভাল, কিন্তু ওভার-কনফিডেন্স ভাল নয়, নরকাসুর’ ধরাধরেন্দ্র চমক সামলে গর্জে উঠলেন ‘দূর ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে সিনেমা-সিরিয়ালে নির্বোধ লেখক-পরিচালকেরা এমন অবাস্তব সংলাপ এবং দৃশ্যায়নের কল্পনা করবেন। কিন্তু বাস্তবে এসব হয় না। ধরো তলোয়ার। দেখি কেমন তোমার বীরত্ব ?’

অসিযুদ্ধে বেশীক্ষণ নরকের সামনে দাঁড়াতে পারলেন না ধরাধরেন্দ্র। 

'সৈন‍্য আর পন্ডিতদের ডাকুন এবার। সমস্ত বিদ্যার পরীক্ষা হয়ে যাক' নরক এবার গর্জন করলেন।

'ওহে ঐন্দ্রজালিক, তুমি এখানে কিন্তু প্রেমকাহিনী রচনা করতে এসেছো, বিদ‍্যে জাহির করতে নয় ' একটু যেন ডিফেন্সিভ মোডে চলে গেলেন ধরাধরেন্দ্র 'প্রত‍্যেকটা স্টেপ বুঝে বুঝে ফেলো, বাছাধন। নইলে অর্ধেক রাজত্ব সহ রাজকন্যা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে'

'বাবাজীবন, যুদ্ধবিগ্রহ না করে, তন্ত্রমন্ত্রের শো-অফ না দেখিয়ে বাস্তবের সঙ্গে একটু আপোষ করো' মহারাণী মুখ খুললেন এবার 'আমার একমাত্র মেয়ে চরম রোমান্টিক প্রেমকাহিনী চায়...'

'বেশ। আমি আগে বিস্তারিত টার্মস অফ রেফারেন্স জমা দিই। আপনারা দেখুন, প্রশ্ন করুন, উত্তর শুনুন...'

'আমিও আমার টার্মস অফ রেফারেন্সে দু'তিনবার অনার কিলিং-এর অ্যাটেম্পট রাখব...' ধরাধরেন্দ্র ইন্টারফেয়ার করলেন।

'ওফফ, এই লোকটাকে নিয়ে পারা যাবে না' মহারাণী বিরক্ত।

'বাবা, মা, আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই' প্রজ্ঞা গম্ভীর হলেন 'যদি চাও, তোমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারো। কথাগুলো অত্যন্ত গভীর। তোমরা হয়ত আমাদের এই উনিশ-কুড়ি বছরের প্রেমকাহিনীকে চরম তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছো, কিন্তু আমাদের এ কাহিনীতে অনেক যুগের স্পর্শ রয়েছে, এই প্রাগজ্যোতিষ -পুনর্ভবা- সরস্বতী- দৃষদ্বতী বিধৌত বিস্তীর্ণ ভূমির বহুস্তরীয় ইতিহাসের স্পর্শ রয়েছে। অল্পকালের মধ্যেই আমাদের দৃষ্টিগম্য আগামীতে আর্যাবর্তে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকেও নাড়া দেবে আমাদের প্রেমকথা...'

'স্বপ্ন না দেখে দুনিয়াটাকে বাস্তবের মাটিতে পা রেখে দেখতে শেখো...' বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে গেল প্রজ্ঞার স্বপ্নটা। হস্টেলের ঘরের দরজায় নক। দরজা খুলতেই সেই সুপুরুষ সিনিয়র দাদা। গতকালের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বারবার চোখে চোখ পড়েছিল প্রজ্ঞার। নাম সুরজিৎ। অনুষ্ঠানের শেষে লম্বা-চওড়া কথায়, শো-অফে, সেন্স অফ হিউমারে অনেকটাই পটিয়ে ফেলেছে প্রজ্ঞাকে। আজ বোধহয় বাকিটুকু করতে এসেছে।

'কি ব্যাপার, প্রজ্ঞাদেবী? এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছেন? নরকাসুরের স্বপ্ন-টপ্ন দেখলেন নাকি ?'

'স্ট্রেঞ্জ! আপনি কিভাবে গেস করলেন ?'

'গত তিন বছরে দেখছি তো। গৌহাটির এই নরকাসুর হিলটপে মেডিক্যাল কলেজে পড়তে এসে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের পরদিন কোন না কোন সুন্দরী ওই স্বপ্ন দেখেই। আগে নরকাসুরের প্রেমকথা নিয়ে নাটক হত। আমিই হিরোর রোলটা করতাম' নায়কোচিত ভঙ্গীতে নিজের চুলে আঙুল চালাল সুরজিৎ 'এনিওয়ে, স্বপ্নে প্রেমকাহিনী কদ্দুর এগোলো' ?

'এগোয়নি মশাই, পিছিয়েছে। আমার বাবার ওই 'নরক' নামে আপত্তি আছে। পরবর্তী স্বপ্নে উনি ঘটক ধরে ভাল ভাল নামের পাত্র খুঁজে এই প্রেমকাহিনী ভেঙে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন...'

'অ্যাই মরিয়েসে ! তা তুমি...মানে আপনিও বেশ কড়া করে স্বপ্ন দেখুন। আর সেসব স্বপ্নে ওইসব ঘটককে ভাগিয়ে সরাসরি আসল নরককে ঢোকান...'

'আসল নরক পামু কই'?

'আমিই রোলটা করে দিতে পারি। আমার উজানি আসামে তিনটে চাবাগান আছে, দার্জিলিয়ের কাছে আরো দু'টো। এই নর্থ-ইস্টের চারটে স্টেটে মোট ছ'খানা হোটেল আছে। জালুকবাড়িতে সুবিশাল রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি। শিলং, তাওয়াং, ডিব্রুগড়ে আরো তিনটে বিশাল বাগানবাড়ি। আর আমাদের বংশেও একটা মিথ আছে, আমরা দিহিঙ্গিয়া রাজাদের বংশধর। এমনি এমনি আমি নরকাসুরের রোলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই নি' সিলভেস্টার স্ট্যালোনের স্টাইলে সিগারেট ধরিয়ে কুন্দনলাল সায়গলের স্টাইলে হাসল সুরজিৎ 'চলুন, ক্যান্টিনে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে বাকি গল্পটা বলছি। আমি কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি...'

'কেন'?

'সেটাই তো গল্প। কাল সারারাত অর্ধতন্দ্রায় ঘোড়ায় চড়ে হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়েছি… হাজার আলোকবর্ষও বলতে পারেন...'

'কেন'?

'শুধু আপনাকে পাওয়ার জন্য' ব্রেকফাস্ট টেবিলের চা থেকে ছলকে পড়ল যেন একটা রূপকথা। আরো গভীর রূপকথা ডানা মেলল কথায় কথায়। সেদিন কলেজের ক্লাস মিস হল প্রজ্ঞার। সেসময় রূপকথার গল্প চলল নেহরু পার্কের নির্জনতায়। সুরজিৎ যেন সত্যিই এক জাদুকর। এক অলৌকিক মায়ারাজ্যের অগাধ নদীর কান্ডারী যেন ও। সপ্তপর্ণের ভরে ওঠা তরুক্ষীরগন্ধের পাশে, কুসুমকোরকলোভী ভ্রমরের গুঞ্জনের পাশে, মেঘদূতের গভীরতম মন্দ্রাক্রান্তা ধ্বনির পাশে যেন অনন্তকাল ধরে এক দৃশ্যকাব্য রচনা করে চলেছে সুরজিৎ। শুরু নেই, শেষ নেই। সেই অসীম অনন্তের শ্রোতা শুধু প্রজ্ঞা।গোটা সপ্তাহে আরো তিন দিন ক্লাস মিস হল প্রজ্ঞার। হোয়্যাটস্‌ অ্যাপ আর মেসেঞ্জার ভেসে গেল চ্যাট, ভিডিও কলিং আর অডিও কলিংয়ে। দু'জনেরই ফোন হ্যাং করল বারবার। আহার-নিদ্রা ভুলে গিয়ে জীবনও হ্যাং করে রইল স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে। কল্পলোকের কুসুম বিছানো পথে হেঁটে হেঁটে কেটে গেল আরো তিনটে সপ্তাহ।

তারপর এক সন্ধেয় 'ভারত প্রেমকথা'র আলোচনা হতে হতে সুরজিৎ বলল 'আজ রাতে একটা সারপ্রাইজ আছে। ঘুমিও না যেন। একটা-দেড়টা নাগাদ মেসেজ করে শুরু হবে ব্যাপারটা' 

'একটু হিন্ট দাও'

'হিন্ট দিলে আর সারপ্রাইজ থাকে ? একটু ধৈর্য্য ধরেই দ্যাখো না ! সবুরের ফল মিঠা হয়'

রাত দেড়টার সময় চোখে সামান্য তন্দ্রা এসেছিল প্রজ্ঞার। হঠাৎ হোয়্যাটস্‌ অ্যাপে একটা ভিডিও। দু'টি রাক্ষুসে মাগুর মাছের সঙ্গমদৃশ্যের ভিডিও। কেমন গা-ঘিনঘিনে দৃশ্য। উপেক্ষা করল প্রজ্ঞা। ঠিক চার মিনিট পর আবার সুরজিতের ভিডিও মেসেজ। এবার দু'টি বিষাক্ত সাপের সঙ্গম। সামান্য বিরক্ত হয়ে প্রজ্ঞা মেসেজ করল 'এনিথিং রং ? এই ভিডিওগুলো পাঠাচ্ছ কেন' ?

'এগুলোই পাঠাব এখন থেকে'

'হোয়্যাট ? কি বলতে চাও? আর ইয়্যু ওকে'?

'অ্যাবসল্যুটলি ফাইন। সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আবার বলছি, এগুলোই পাঠাব'

'মানে'?

'মানে মাছকে আর কত খেলাব ? চার সপ্তাহ তো খেলালাম। এবার ডাঙায় তুলতে হবে...'

'মাছ ? কে মাছ ? আর ইয়্যু জোকিং ? কেমন যেন অচেনা লাগছে তোমায়' ?

'এখন যে অচেনা লাগলে হবে না, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। বড়শি এখন গেঁথে গিয়েছে আপনার মুখে। খেয়াল করে দেখো, গত চার সপ্তাহে তোমার সবকিছু উজাড় করে আমাকে দিয়ে দিয়েছো তুমি। সমস্ত পাসওয়ার্ড পর্যন্ত। এ ভুলভুলাইয়া থেকে এখন তো তুমি বেরোতে পারবে না' 

ভয়ের অতল অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে আর মেসেজ করতে পারল না প্রজ্ঞা। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনই করে বসল 'আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না, সুরজিৎ...'

'আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। রাজার সাথে প্রেম করতে চাইলে তোমাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। সেটারই আভাস দিতে চাইছিলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো। একটা মাছকে বেশীক্ষণ খেলানোর ধৈর্য্য আমার থাকে না। গত তিন বছরে এই মেডিক্যাল কলেজেরই চারটে মেয়েকে ছিবড়ে করে দিয়েছি। তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার খুব কঠিন দৈহিক সঙ্গম। প্রথমে বেশ রক্তপাত হয়। পরে মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। ছুটিতে বাড়ি ফিরে আমার নিজের বোনের সঙ্গেও তান্ত্রিক সঙ্গম করেছি প্রচুর। আমি চাই, এসব কিছুর সাথে তুমি মানিয়ে নাও...'

অতল অন্ধকারের মধ্যে মাথা ঘুরতে লাগল প্রজ্ঞার। প্রবল এক বমনেচ্ছা থরথর করে কাঁপিয়ে দিল শরীরটাকে। তার মধ্যেও স্পীকার মোডে রাখা ফোনটা থেকে স্পষ্ট শুনল 'আজ রাতে আড়াইটের সময় তোমার কাছে আসছি। পালানোর চেষ্টা কোরো না। তোমার হস্টেলের দরজার বাইরেই আমার রাজসৈন্যরা প্রস্তুত আছে। আর এটাও শুনে নাও যে, প্রশাসনিক সব স্তরে টাকা খাইয়ে আমি সবাইকে বশীভূত করে রেখেছি। তুমি তো আমার ক্ষমতা জানোই। বেগড়বাই করলে নেহেরু পার্কের পিছনে কাল সকালে একটা লাশ পাওয়া যাবে...'

হস্টেলের ঘরের ভিতর সবকিছু যেন এক ভয়ার্ত তরল অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে। বইখাতা, জামাকাপড়, প্রজ্ঞার অকালপ্রয়াত বাবামায়ের ছবিটা -সব কিছু যেন চরম শূন্য, শুষ্ক, ভয়ার্ত এক হাঁ-মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রবল এক শূন্যতার খিদে আস্তে আস্তে গা-ঘিনঘিনে করে তুলছে সব। মাত্র চল্লিশ মিনিট সময় আছে হাতে। আর দেরি করল না প্রজ্ঞা। সিলিং ফ্যানের হুকটায় শক্ত করে বেঁধে ফেলল নিজের ওড়নাটা। বাইরে তখন শারদ পূর্ণিমার ঘন জ্যোৎস্নায় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। 

       

তন্ময় ধর


জন্ম - হুগলী জেলার কোন্নগর নবগ্রামে। লেখালিখির শুরু ২০০২ সালে কবিতা ক‍্যাম্পাস পত্রিকায়। নিয়মিত গল্প লিখেছেন আনন্দমেলা, দৈনিক স্টেটসম‍্যান, শুকতারা ইত্যাদিতে, কবিতা লিখেছেন দেশ, সানন্দা, কবিসম্মেলন, কৌরব ইত্যাদি পত্রিকায় এবং অসংখ্য ওয়েব ম‍্যাগে। ছড়া লিখেছেন আনন্দবাজার, কিশোর ভারতী, উদ্বোধন, গণশক্তি প্রভৃতিতে। ওয়েব-সাহিত্য জগতে ছড়ার জন‍্য পেয়েছেন "সরল দে স্মৃতি পুরস্কার"। সম্পাদনা করেন উষ্ণিক নামক মাসিক ওয়েবজিনের। এযাবৎ ছয়টি কাব‍্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Wednesday 14 September 2022

সংখ্যা অষ্টাদশ ।।১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ।। ফুল ফোটার সময় ।। আশুতোষ দেবনাথ

 ফুল ফোটার সময় 

আশুতোষ দেবনাথ

 

বেশ কিছুদিন হলো টের পাচ্ছি আবহাওয়ার পরিবর্তন। বাতাস দিক পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। উত্তরের পরিবর্তে দক্ষিণ থেকে আসছে মনকেমন করা বাতাস। তাহলে কি শীত গিয়ে বসন্তের আগমন ঘটতে শুরু করেছে । হয়তো তাই হবে। শিমুল পলাশের শাখা - প্রশাখায় কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে। গাছে গাছে আমের মুকুলে মৌমাছিদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনতে পাচ্ছি। আর এ সবের জন্যে কি আমার ভিতরটা রাঙিয়ে উঠতে চাইছে। 

কিন্তু কার জন্যে ? এই সময় আমার জন্য ঘরে আলো জ্বালিয়ে যার অপেক্ষায় থাকবার কথা সে তো নেই। ফাঁকা ঘরে এখন নিকষ কালো অন্ধকার। হ্যাঁ, আমাদের সেই ঝিল পাড়ে, ছোট্ট টালির শেডের ঘর। দরমার বেড়া। যার অনেক ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়তো পোষ - মাঘের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া - বাতাস। তবু সেই সময়টা আমার কাছে অন্যরকম ছিল।  আমি আমার  অনুভূতির ফাঁক - ফোকরগুলি ঢেকে রাখতে পেরেছি তোমার জন্যে।


আর এখন ...? সেই কাক ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক চেনা জানা পরিচিত জনের সঙ্গে দেখা - সাক্ষাৎ করেছি আবার নতুন একটা কাজের জন্য। যে করে হোক আমার উপযোগী,  সে কম্পোজের কাজ হোক বা প্রুফ দেখার কাজই হোক কোথায়ও কোনো একটা কর্ম সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত আমার যে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।  সদরে মুদিখানার দোকানে, দুধের দোকানে, সবজির দোকানে, কাপড়ের দোকানে আমার কিছু ধার - দেনা এখনও থেকে গেছে। দেখা - সাক্ষাৎ হলে তাঁরা খুবই মার্জিত ভাবে বলে, দাদা ভালো আছেন। খবর করবেন কবে - আপনি তো সবই বোঝেন। জানি বাকি সবার মত আপনি টাকা না দিয়ে পারবেন না।

তাদের খুব শিগগিরই তাদের পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে না হলে এ ভাবে আর কতদিন পালিয়ে পালিয়ে যাতায়াত করব ?


প্রকাশন সংস্থাটা হটাৎ এভাবে বন্ধ হয়ে যাবে কখনো ভাবিনি। বেশ ভালই তো চলছিল। মালিক দীনবন্ধু মিত্র আমাদের খুবই স্বজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর " প্রগতি প্রিন্টিং অফসেট " উদ্বোধনের সময় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করেছিলেন। হ্যাঁ, তাদের উপস্থিতিতে  মালিক দীনবন্ধু অনেক অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাদের সবাইকে। আমরা যারা কর্মচারী ছিলাম তাদের উদ্দেশ্যে।

তাঁর প্রতিশ্রুতি মত প্রেসটা বেশ ভালই চলছিল। উত্তরোত্তর প্রেসের আরো উন্নতি হবে এই আশা ভরসায় আমরা আমাদের ভালোবাসার ঘর - সংসার বেঁধেছিলাম। আর কি আশ্চর্য ! আমাদের ঘর বাঁধার পরই ঘটলো সেই অভাবনীয় ঘটনা। যা আমরা কখনো ভাবতে পারিনি সেটাই ঘটলো। মালিক প্রেসের কর্মচারীদের পি. এফ্ - এর সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করে প্রেসটা বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিল। তারপর থেকেই শুরু হলো অবস্থান বিক্ষোভের কর্মসূচি। সেই সঙ্গে জীবিকার চেষ্টাও। দু ' মাস না যেতেই মুদিওলা, সবজির দোকানদার, দুধের দোকানদার আরো অনেকে তাগাদা দিতে শুরু করলো। দাদা, খবর করছেন কবে ? এইভাবে টাকা ফেলে রাখলে কারবার চালাই কি করে বলুন ? এর বেশি কিছু তাঁরা আমাকে বলত না ।  

তবু কেন জানি একটা আত্মসম্মান বোধের জন্য আমি ওদের সামনে যেতে পারি না।

হয়তো তুমি বলবে তোমার আবার আত্মসম্মান বোধ আছে নাকি ?

হ্যাঁ, সীমা। আমার মধ্যে এক সময়ে সব রকম অনুভুতি ছিলো। ছিল প্রেম ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা । তোমার মনে আছে সীমা, যখন তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল বিজয় দা'র বাড়িতে। প্রথম দিন আমি তোমার চোখে দেখেছিলাম সাগরের গভীরতা। সেদিনের সে কথা মনে পড়লে আজও আমার ভিতরে জাগে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি ও অনুরণন। কিন্তু আজকাল কেন জানি আমার সমস্ত অনুভূতি, স্নেহ, প্রেম - ভালোবাসা, দয়া, মায়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘরে ফিরে মনে হয় সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা। কেন জানি টের পাই তোমার উপস্থিতি। আলনায় রাখা রয়েছে তোমার শাড়ী, ব্লাউজ ,  নাইটি । দিয়ার জামা ইত্যাদি। ওই বুঝি দিয়া ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে মা মা করে । এতসব টানা - পোড়েন - এ আলো - আঁধারের রহস্যের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে  আমার মনে হচ্ছে হয়তো ঘরে গিয়ে দেখব তুমি আলো জ্বেলে আমার অপেক্ষায় বসে আছ। তুমি যখন ছিলে তখন তো আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আলো নিয়ে অপেক্ষা করতে। এখন এই অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে বারবার মনে পড়ছে তোমার উপস্থিতি। যা আমার স্মৃতির দরজায় বারবার কড়া নেড়ে যায়।


দুই


পকেট থেকে চাবি বের করে অন্ধকারে হাত বুলিয়ে অনেক দিনের অভ্যাসে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে থমকে যাই। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে দেশলাই খুঁজে নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে  দেখি সবকিছু ঠিক আছে কি না। ছোট মোমবাতি ঘরের খুব একটা অন্ধকার দুর করতে পারে না। কোণে কোণে জমে থাকে অন্ধকার।  সেই অন্ধকারে চলে ইদুর, আরশোলা, আরো নানা রকম পোকার দৌরাত্ম। আলো দেখে ওরা পালিয়ে গেলো অন্ধকার ঘুপচি কোণে। তারপর সব শুনশান। কেমন একটা দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতায় ধীরে ধীরে আমি ডুবে যাই। অনেকদিন আমি চুল - দাড়ি কাটাতে সেলুনে যাই না। শার্ট - প্যান্ট ময়লা। রাতের অন্ধকারে পাড়ার কুকুরগুলো আমাকে চিনতে না পেরে তেড়ে আসে।  রাতে দিদির বাড়ি থেকে খেয়ে আসি । তবু এইসব চিন্তাভাবনার ঘেরাটোপে ঘুম আসে না।  জেগে থেকে এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়। আমি জেগে থাকি। জেগে থেকে একটা ভারী অদ্ভুত গন্ধ টের পাই। ভারী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ।


কোথা থেকে আসছে ?  এইরকম গন্ধ তো আসবার কথা না। আমি তো এতদিন যাবৎ মরা পচা ইদুর আরশোলা টিকটিকির গন্ধে অভ্যস্ত। যে গন্ধে নাক চেপে ধরে ওয়াক থু করে ফেলতে হয়। এই মিষ্টি সুগন্ধে শরীর মনে পুলক ছড়িয়ে যাচ্ছে। রক্তে দোলা দিয়ে যাচ্ছে ভালো লাগা শিহরণ। আমি অন্ধকারে উঠে গিয়ে খুঁজতে থাকি এই গন্ধ কোথা থেকে আসছে জানার জন্য। এদিক সেদিক তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথায়ও কিছু পাই না। শেষে ঘরের পিছনের দরজা খুলে আমি থমকে গেলাম।


এ কী !


অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে ঝলমল করছে টবের কামিনী ফুল গাছটা। সাদা সাদা থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে গেছে গাছের শাখা - প্রশাখায়। সাদাসাদা থোকা থোকা ফুল ফুটে ভরে রয়েছে টবে লাগানো কামিনী ফুল গাছে। কামিনী ফুল ভারী একটা হালকা মিষ্টি গন্ধে ভরা যা মনের 

চোরাগলি দিয়ে ঢুকে পড়ে মনের একান্ত মণিকোঠায়।


তিন

এই রকম আগেও আমি কত কামিনী ফুলের চারা এনে টবে লাগিয়েছি।  বেশিদিন বাঁচেনি ।  বাঁচাতে পারিনি। যা উৎসাহ উদ্দীপনা ওই শিয়ালদায় ফুলের চারা বিক্রেতার কাছ থেকে চারা কিনে এনে টবে লাগানোর পর দু ' চার দিন। পরে আর ঠিক মত জল, সার দেওয়া হয়নি। রোদ লাগানো হয়নি। অযত্নে অবহেলায় মরে গেছে। আবার কিছুদিন পরে কোথাও কোনো ফুলের চারা বিক্রেতাকে দেখলে ছুটে গেছি। একবার ব্যর্থ হয়েও আমি বারবার ছুটে গেছি ফুল ফোটানোর নেশায়।

কামিনী ফুলের চারা টবে লাগাতে দেখে সেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, কি পাগলামি করছো তুমি। কামিনী ফুলের গাছ কেউ কখনো টবে লাগায় নাকি ? কামিনী ফুলগাছ তো মাটিতে হয়, মাটিতে । আমাদের পলাশপুর বাগানে কত গাছ ছিল। ফুল ফুটলে গন্ধে গন্ধে সাপ চলে আসে, সাপ । তুমি  জান না ?

আমি বলেছিলাম, এখানে সাপ আসবে কোথা থেকে এত ঘন জন বসতিতে ?

তবু তুমি বললে, লাগাতে হবে না। লাগালে আমি ফেলে দেব।  সেদিন তোমার কথা না শোনাতে রেগে গিয়ে কামিনী ফুলের চারাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে। পরে আবার রাগ পড়ে গেলে নিজেই চারাটা যত্ন করে টবে লাগিয়েছিলে। শুধু লাগিয়েই থেমে থাকনি। দু - বেলা চাল ধোয়া জল দিয়েছ। সার দিয়েছ। রোদে দিয়েছ।  তোমার হাতের গুণে পরম যতনে সেই কামিনী ফুল গাছ ঝাঁপিয়ে বেড়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে আমি বাড়ন্ত ডালপালা কেটে দিয়েছি। বাড়িতে কেউ এলে জিজ্ঞেস করেছে, এটা কী ফুলগাছ ? কখন ফুল ফুটবে ? এই ফুলে কী গন্ধ ছড়াবে ?


চার

তোমারও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়েছে টবের এই ফুল গাছে সত্যি কোনো দিন ফুল ফুটবে কিনা ।

তোমার সন্দেহ দুর করে আমি বলতাম, ফুল ফুটবে না মানে, একদিন ঠিকই ফুটবে। এ যে আমাদের প্রেম - ভালোবাসার গাছ। রমণীর হাতের ছোঁয়ায় এই গাছে ফুল না ফুটে পারে।

এতদিন পরে আজ সেই ফুলগাছের শাখা - প্রশাখায় অজস্র ফুল ফুটেছে। সাদা সাদা। গন্ধে গন্ধে মাতোয়ারা। দেখতে কী সুন্দর। বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি জান সীমা, কামিনী ফুলগাছের শিকড় টবের নিচ থেকে ভেদ করে মাটির গভীরে প্রবেশ করেছে। সেই কারণে  তোমাকে এই চিঠি লেখা।  আমি জানি তুমি একদিন ঠিকই ফিরে আসবে  দিয়াকে নিয়ে।

ততদিনে আমরা আবার প্রতিষ্ঠা করতে পারব আমাদের প্রকাশন সংস্থাটিকে।


হ্যাঁ, আমরা নিজেরাই।

 ........

আশুতোষ দেবনাথ


জন্ম : ১৯৫৪ ওপার বাংলার বাগেরহাট। সেখানে মাঠ- নদী, সবুজ- বন প্রান্তর সব কিছুই ছিল। তবুও চলে আসতে হয় দেশভাগ ও দাঙ্গার কারণে ষাটের দশকের মাঝামাঝি। উদ্বাস্তু জীবনের কঠিন টানাপোড়েনের মধ্যে লেখাপড়া শেষ না করেই জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়া। সত্তর দশকের মাঝামাঝি লেটার প্রেসে কম্পোজিটরের কাজ করার সময়ে প্রথম গল্প 

" বোধনের সময়" ক্রান্তিক পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে ছোটোগল্প লেখা শুরু। পরবর্তী কালে কলকাতার প্রায় সমস্ত পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। " জীবন জীবিতের", "অন্য রণভূমি" উল্লেখযোগ্য গল্প গ্রন্থ।

Wednesday 7 September 2022

সংখ্যা সপ্তদশ ।। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ।। একটি সুন্দর ফাঁসির আদেশ ।। সাইয়িদ রফিকুল হক

  একটি সুন্দর ফাঁসির আদেশ

সাইয়িদ রফিকুল হক


মন্দিরের পাশে একখানা ধানক্ষেত। আগে এটা মন্দিরের জায়গাই ছিল। কিন্তু এখন এটা একজন মুসলমান চাষির দখলে। ১৯৭১ সালে, এই জমির মালিক রাধাগোবিন্দ সাহা যখন প্রাণভয়ে সপরিবারে টাঙ্গাইলের এক নিভৃত পল্লিতে আত্মগোপন করলেন তখন এসব পড়ে ছিল এখানেই। তিনি এসব ফেলে চলে গিয়েছিলেন। জীবনে বেঁচে না-থাকলে জমি দিয়ে কী করবেন তিনি?

দেশ স্বাধীন হলো একসময়। কয়েক মাস পরে আবার তিনি নিজের ভিটায় ফিরে এলেন। ততদিনে মন্দিরের পাশের জমিটা দখল করে নিয়েছে সোনাপদ্মা-গ্রামের আফাজ-কামলা। দখল অবশ্য সে একা-একা করেনি। তাকে সাহায্য করেছিল তৎকালীন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও শান্তিকমিটির নেতা ইসহাক খাঁ। সে তখন পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশের নিরীহ হিন্দুনারীদের ধরে-ধরে পাকিস্তানি-হানাদারবাহিনীর ক্যাম্পে পাঠাতো। আর পাকিস্তানি নরপশুগুলো নির্বিচারে হিন্দুনারীদের ধর্ষণ করতো। এমনকি সে মুসলমান-নারীদেরও তুলে দিতো পাক-আর্মিদের হাতে। এই সময় রাজাকার-কমান্ডার ইসহাক খাঁ পাকিস্তানিদের খুব খুশি করে গ্রামের-পর-গ্রামে নির্বিচারে করতো লুটপাট। বিশেষভাবে, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি কিছুতেই রেহাই পেতো না। ইসহাক খাঁকে সেই সময় সবরকমের সাহায্য-সহযোগিতা করতো এই আফাজ-কামলা।

রাধাগোবিন্দ সাহার পরিবার রাতের আঁধারে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ায় তার পরিবারের কোনো নারীসদস্যকে ওরা পাকিস্তানি ক্যাম্পে পাঠাতে পারেনি। সেই রাগে, ক্ষোভে-দুঃখে একাত্তরের রাজাকার আফাজ-কামলাকে এই জমিটা গায়ের জোরে দিয়ে দেয় যুদ্ধাপরাধী ইসহাক খাঁ। সেই থেকে আফাজ-কামলা রাধাগোবিন্দ সাহার এই জমিটা নিশ্চিন্তে ভোগদখল করে আসছে। জমির খাজনা দেয় রাধাগোবিন্দ সাহা। আর জমি চাষ করে ফসল খায়, আর মালিকানা বুঝে নেয় আফাজ-কামলা ! এ যেন ‘ডিম পাড়ে হাঁসে খায় বাঘডাশে’ প্রবাদের মতো।

ওদের হাত থেকে পঞ্চাশ বছরেও জমিটা ছাড়াতে পারেননি রাধাগোবিন্দ। তিনি প্রাণভয়ে আদালতেও যেতে পারেন না। যদি এতে রাগান্বিত হয়ে ওরা আবার খুনখারাবি করে বসে ! কিংবা একাত্তর সালের মতো আবার রাতের আঁধারে তার পরিবারের সদস্যদের ধর্ষণ করতে উদ্যত হয় ! তাই, এতটা বছর তিনি এসব নীরবে সয়ে যাচ্ছেন। ১৯৭১ সালে, ওরা বহু হিন্দুকে হত্যা করেছে। হিন্দুমানুষকে দেখতে পেলে ওরা তাকে আর বাঁচতে দিতো না। ওরা এমনই ভয়ংকর রাজাকার!

একদাগে এখানে সাড়ে তিন বিঘা জমি আছে। আফাজ-কামলার বাপ-দাদারা কখনো একসঙ্গে-একদাগে এত জমি দেখেনি। এমনকি তা দেখেনি তার চৌদ্দপুরুষও। সে এখন কিছুতেই এই জমি ছাড়তে নারাজ।

সে এখন পরের জমির ফসল খায়! চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়। আর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে! দিনকাল তার ভালোই কেটে যাচ্ছে।

জমিটা অনেক সুন্দর বলে রাধাগোবিন্দ এখন প্রায়ই জমিটা দেখতে মন্দিরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। জমিটার ফসল দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায় ! তবুও তিনি কিছু করতে বা বলতে পারেন না। তার সবকিছু খাচ্ছে এখন বাঘডাশে !

সেদিন খুব ভোরে মন্দিরের পাশের ওই জমিটাতে প্রবল হইচই, চিৎকার ও চেঁচামেচি শুনে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। তারপর ছুটে গেলেন সেখানে।

কাছে গিয়ে দেখেন, পাশের জমির চাষি মনছের প্রামাণিকের সঙ্গে আফাজ-কামলা ও তার দুই ছেলে ভয়ানক মারামারি বাঁধিয়েছে। তা দেখে তিনি একবার সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু আবার ভাবলেন, ঘটনাটা না-দেখলে শেষে আফসোস করতে হবে—ভেবে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। 

আফাজ-কামলার বড়-বড় জওয়ান দুই ছেলে আছে। তারাও কোমরবেঁধে বাপের সঙ্গে মারামারি করছে। অন্যদিকে মনছের প্রামাণিকের একমাত্র ছেলে তয়ছের বাপকে বাঁচানোর জন্য নানারকম চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।

মারামারির একপর্যায়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আফাজ-কামলার বড়ছেলে লুৎফর বড় কোদালটার গোড়া দিয়ে মনছের প্রামাণিকের মাথায় প্রচন্ড জোরে আঘাত করলো। আর এক আঘাতেই মাথা ফেটে সেখানেই মারা গেল মনছের। তার এই দশা দেখে এক চিৎকার দিয়ে সেখান থেকে তয়ছের পালিয়ে গেল। সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে—তাকেও না আবার খুন করে ওরা !

ওরা মনছেরকে মেরে কিছুসময়ের জন্য হতবুদ্ধি যেন ! তারপর আফাজ সংবিৎ ফিরে পেয়ে লুৎফরের দিকে তাকালো। আর বললো, “ওটাকেও শেষ করে দে, বাজান। নইলে, জানে বাঁচতে পারবি নানে। সাক্ষী থাইকে যাইবেনে। সাক্ষী রাখা পাপ !”

কিন্তু তার আগেই তয়ছের পগার পাড়ি দিয়েছে। তাকে আর ধরতে পারেনি ওরা।

ওদের এমন একটা ভয়ানক কাণ্ড দেখে হাত বিশেক দূরে দাঁড়ানো রাধাগোবিন্দ সাহাও একসময় সভয়ে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে আসেন। তার শরীরটা কাঁপছিল। তিনি খুব ভয় পেয়েছেন—তাকেও না আবার ওরা মেরে ফেলে !

আফাজ-কামলারা দেখেছে, এই ঘটনার সাক্ষী রয়ে গেছে দুজন। এক হচ্ছে, তয়ছের। আরেকজন রাধাগোবিন্দ সাহা।

পুলিশ আসতে বেশি দেরি হয়নি। থানার পাশের গ্রাম। লাশ নিয়ে থানায় চলে গেছে তারা। লাশের ময়নাতদন্ত হবে। তখনও মামলা হয়নি কারও নামে। 

খানিকক্ষণ পরে তয়ছের তার লোকজনদের নিয়ে থানায় গেল মামলাদায়ের করতে।

দারোগা এরই মধ্যে আফাজ-কামলার লাখ টাকা খেয়ে বসে আছে। সে তয়ছেরকে বললো, “নিজের বাপকে খুন করেছিস, ব্যাটা। এখন দোষ দিচ্ছিস নিরীহ আফাজ সেখের নামে ! তুই মামলা করতে পারবি না। ভালো চাইলে পালিয়ে যা। তোকে আমি ধরবো না। যা, পালিয়ে যা। এই তোকে সুযোগ দিলাম।”

কথাটা শুনে মাথা ঘুরে যায় তয়ছেরের। তবুও সে মনোবল হারায় না। শেষমেশ তার মনে পড়লো, রাধাগোবিন্দ সাহার কথা। তিনি তো মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলেন। 

সে তখন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো, “দারোগাসাহেব, আমাদের পাড়ার গোবিন্দ কাকাও ঘটনাটা দেখেছেন।”

কিন্তু পুলিশ কিছুতেই বিশ্বাস করে না তার কথা। তার কাছে সত্যের চেয়ে টাকার মূল্য বেশি। সে মামলা নিতে গড়িমসি করছে। এমনকি মামলা নিলোও না।

কদিন পরে পুলিশ মামলা নিয়েছে এলাকার এমপি-সাহেবের কথায়। কিন্তু পুলিশ, আসামিদের আর ধরে না। দারোগা মনের মতো করে লিখে দিয়েছে—এই মামলার কোনো সাক্ষীসাবুদ নেই !

আবার উপর থেকে আদেশ আসে। এমপিসাহেব জোরেশোরে একটা ধমক দিলেন দারোগাকে। এবার দারোগা নড়েচড়ে বসলো। বাধ্য হয়ে মামলাটা নতুনভাবে সাজায়। তারা লেখে, ‘মনছের সেদিন ভোরে তার জমিতে ছেলের সঙ্গে কাজ করছিল। হঠাৎ সেখানে মারামারি বেঁধে যায় ! আর খুন হয় মনছের। কিন্তু কার সঙ্গে কার মারামারি ? আর কে তাকে খুন করেছে—তা পরিষ্কার করে লেখে না দারোগা। আর এই ঘটনায় তয়ছের ব্যতীত প্রধান সাক্ষী হলো জমিটার পাশের বাড়ির রাধাগোবিন্দ সাহা।’ তা অবশ্য দারোগা লিখেছে।

দারোগা সঙ্গে-সঙ্গে আফাজ-কামলাকে এও বলে দিয়েছে, গোবিন্দ সাহাকে ম্যানেজ করলেই মামলা খতম। কারণ, তয়ছেরের একার কথায় আদালত রায় দিবে না। এটা খুব ভালোভাবে বুঝে নিয়েছে আফাজ-কামলা ও তার ছেলেরা।

এদিকে রাতের আঁধারে দুই ছেলেকে সঙ্গে করে গোবিন্দ সাহার বাড়িতে এসে আফাজ-কামলা বলে গেছে, “দাদা, সত্যি কথাটা বলবেন !”

গোবিন্দ সাহা ভয়ে-ভয়ে বললেন, “কী সেই সত্য কথাটা ?”

আফাজ-কামলা বলে, “আপনি বলবেন, আমার চোখের সামনে জমিতে কাজ করার সময় রাগের বশে নিজের বাপকে কোদাল দিয়ে কোপ দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে তয়ছের। আর এতে মারা যায় মনছের। আর যদি বাদীপক্ষের উকিল বলে—আপনি সেখানে তখন কী করতে গেছিলেন ? তখন বলবেন, আমার বাড়ির পাশের জমি এটা। সেদিন একটা চেঁচামেচি শুনে সেখানে আমি ছুটে যাই। আর গিয়ে চোখের সামনে ঘটনাটা দেখতে পেয়েছি। আর-কিছু বললে বলবেন, আমি প্রায় প্রতিদিন সকালে মন্দির দেখতে যাই। তাই, ওদের ভালোভাবে চিনি।”

গোবিন্দ সাহা ভয়ে-ভয়ে বললেন, “আচ্ছা।”

যাওয়ার সময় তার দুই ছেলেসহ আফাজ-কামলা আবার শাসিয়ে গেছে, “দাদা, সত্যটা বলবেন। একদম সত্য। নইলে, জমি যেটুকু আছে—তাও থাকপে নানে।”

গোবিন্দ সাহা বললেন, “বলবো। সত্যই বলবো।”

দুদিন পরে আবার এমপি-সাহেবের ধমকে দারোগা, আসামি আফাজ-কামলাকে দুই পুত্রসহ গ্রেফতার করতে বাধ্য হলো। দারোগা ওদের বুঝিয়েছে, গোবিন্দ সাহা সাক্ষী দিলে তোমাদের আর চিন্তা নেই। ক’দিন পরেই তোমাদের ছেড়ে দেবো আমি।


কোর্টে যখন তয়ছেরকে সাক্ষী হিসাবে আনা হলো—তখন সে ঘটনাটা একনিঃশ্বাসে বলে ফেললো। এরপর গোবিন্দসাহাকে হাজির করা হলো মামলার প্রধান সাক্ষী হিসাবে। 

গোবিন্দ সাহা এবার ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, “এই জমিটা আমাদের। আমাদের পূর্বপুরুষদের। এটা জোর করে ভোগদখল করছে আফাজ-কামলারা (তারপর তিনি ১৯৭১ সালের পুরো ঘটনাটা বলে গেলেন)। এই জমির আইল নিয়ে প্রায়ই ঝগড়াফাসাদ করতো আফাজ-কামলা ও তার ছেলেরা। সেদিনও তারা মনছের প্রামাণিকের সঙ্গে মারামারি বাঁধিয়ে ফেলে। সেদিন সকালে সেখানে চিৎকার ও চেঁচামেচি শুনে আমি কাছে গিয়ে দেখি, আফাজ-কামলা ও তার ছেলেরা মারামারি করছে। একপর্যায়ে আফাজ-কামলার বড়ছেলে লুৎফর কোদালের গোড়া দিয়ে মনছেরের মাথায় সজোরে আঘাত করে। আর এক আঘাতেই বেচারা মারা যায়। আর তখন নিজের বাপের এই অবস্থা দেখে সেখান থেকে প্রাণভয়ে চিৎকার করতে-করতে ছুটে পালায় তয়ছের। নইলে, তাকেও মারতো ওরা। আমি সেদিন নিজের চোখে সব দেখেছি।” 

তারপর বাদীপক্ষের উকিলের প্রশ্নের জবাবে তিনি তাদের জমিটা দখলের পুরো ঘটনাটা আরও বিশদভাবে বর্ণনা করলেন। সব শুনে আদালত স্তম্ভিত! 

তয়ছের আবার বললো, “বহুদিন আগে থেকে তার বাপকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল এরা তিনজন। আর বলেছিল, হত্যা করে আমাদের এই দুই বিঘার জমিটাও নিয়ে নিবে।”

মামলার প্রধান সাক্ষীর সঙ্গে তয়ছেরও একই কথা বলেছে।

জজসাহেব সবকিছু বুঝতে পারলেন। আর তিনি সেদিনের জনাকীর্ণ এজলাসে রায় ঘোষণার দিনতারিখ ঘোষণা করে বিদায় নিলেন।

দারোগা তারপরও তাদের আশ্বাস দিচ্ছিলো, “ফাঁসি হবে না। তোমাদের আমি বের করে আনবো। কিন্তু, আরেক লাখ টাকা দিয়ো !”

কিন্তু কালোমুখে আর হাসি ফোটে না আফাজ-কামলাদের।

এলাকার সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর মামলা এটা। 

গ্রামবাসী তাই প্রায় প্রতিদিন রায়ের দিন গোনে।

রাধাগোবিন্দ সাহা আগের চেয়ে ভালো আছেন। কেউ তাকে আর হুমকিধমকি দিতে সাহস পায় না। এমনকি থানার দারোগাও না। কারণ, আদালতের নির্দেশ আছে—তার নিরাপত্তার বিধান করতে।

তবুও গুটিকতক মুসলমান ভয় দেখায় তাকে। এরা আফাজ-কামলার জাতভাই। এরা বলে, ‘দাদা, কামডা ভালো হয় নাই। আফাজ ভাই, এবার হজে যাইতে চাইছিলেন ! তারে আপনে আটকায়ে দিছেন!’

গোবিন্দ সাহা কোনো কথা বলেন না। চুপচাপ বসে থাকেন বাড়িতে। প্রয়োজন না-পড়লে বাড়ির বাইরেও খুব-একটা বের হন না তিনি। আর মাঝেমাঝে মন্দিরের পাশের ওই জমিটার কাছে গিয়ে বসে থাকেন।

রায় ঘোষণার দিন গ্রামের অনেকের সঙ্গে রাধাগোবিন্দ সাহাও ছুটলেন জেলা-আদালতে। এখানে, একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই মামলাটা উপজেলা-আদালত থেকে জেলা-আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।


আদালত-প্রাঙ্গণ মানুষের ভিড়ে সয়লাব ! দাঁড়াবার মতো কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। তবুও সাক্ষী হিসাবে গোবিন্দ সাহা ভিড়ের মধ্যে একপাশে দাঁড়াবার মতো একটু জায়গা পেলেন।

জজসাহেব রায় ঘোষণা করতে লাগলেন সকাল সাড়ে এগারোটার সময়। 

তিনি অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু কোনো কথা কারও মাথায় ঢুকলো না। 

শেষে শুনলেন, আফাজ সেখসহ তার দুই পুত্রের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলো। আর আফাজ সেখের দখলে রাখা সাড়ে তিন বিঘা জমিটাও ফিরিয়ে দেওয়া হলো গোবিন্দ সাহাকে। 

আদালত থেকে একলাফে ছুটে বেরিয়ে এলেন গোবিন্দ সাহা !

চোখের জলে ভাসতে-ভাসতে বারবার তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “ভগবান! ভগবান! ভগবান...।” 

তিনি এখন আরও সাহসী হয়ে উঠেছেন। আর নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন।

তার মনে আজ আনন্দ আর ধরে না। একটি সুন্দর ফাঁসির আদেশ হয়েছে আজ !


সাইয়িদ রফিকুল হক

একজন সাহিত্যসেবী, গ্রন্থপ্রেমিক, সমাজ-সচেতন মানুষ ও জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্য তাঁর কাছে সবসময় সর্বাপেক্ষা প্রিয়। মূলত তিনি কবি, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক। বর্তমানে তাঁর লেখা মুক্তচিন্তা, প্রতিলিপি, সামহোয়্যারইন-ব্লগসহ বিভিন্ন ব্লগে ও সাহিত্যপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রকাশিত গ্রন্থ: গোয়েন্দা লালভাই (২০২১), হিজলগাছের রহস্যময় লোকটা (২০২১)।


প্রকাশিত পর্ব

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। ২১সেপ্টেম্বর।। নরকের প্রেমকাহিনী ।। তন্ময় ধর

নরকের প্রেমকাহিনী     তন্ময় ধর  'নরক !! না না, এমন নামের ছেলের সাথে কিছুতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না' কমল মিত্রসুলভ স্বর, দৃষ্টি ও আভি...